স্যার, আপনাকে বইটা পড়তেই হবে। আমার পড়া শেষ হলেই আপনাকে দিয়ে আসব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। শোন ফিরোজ।
বলুন।
কাল রাতে তোমার কেমন ঘুম হয়েছিল?
ভালো।
কী রকম ভালো?
খুব ভালো। এক ঘুমে রাত পার করেছি। কি জন্যে জিজ্ঞেস করছেন স্যার?
এমনি জানতে চাচ্ছি। কোনো স্পেসিফিক কারণ নেই! তুমি কি কাল রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছ?
জ্বি-না স্যার।
চট করে না বলে দিও না। চিন্তা করে তারপর বল।
এবার ও সময় নিল জবাব দেয়ার আগে।
একটা স্বপ্ন দেখেছি। আর ওটা তো আমি প্রায়ই দেখি।
কোনটা?
ঐ যে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি, তারপর দেখি কোনো প্রশ্নের উত্তর জানি না।
এটা ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখ নি?
জ্বি-না।
শোন ফিরোজ, এ ছাড়াও যদি অন্য কোনো স্বপ্নের কথা মনে পড়ে, আমাকে জানিও।
জ্বি আচ্ছা!
তুমি কি আজ সন্ধ্যার দিকে এক বার আসবে?
না স্যার, আজ আসব না। বইটা শেষ করব।
প্রেমের উপন্যাস নাকি?
ফিরোজ লাজুক স্বরে বলল, হুঁ।
টেপগুলো পরীক্ষা করতে-করতে রাত তিনটা বেজে গেল। প্রথম চারটি টেপে তেমন কিছু নেই। এক বার শুধু কিছুক্ষণের জন্যে আহ্ উহ শব্দ। সেটা স্বপ্ন দেখার জন্যে, কিংবা বেকায়দা অবস্থায় শোয়ার জন্যে। তবে শেষ টেপটিতে মিসির আলির জন্যে বড় ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
তিনি বিচিত্র একটি কণ্ঠস্বর শুনলেন সেখানে। তীক্ষ্ণ তীব্ৰ। হাই ফ্রিকোয়েন্সি—
কথাগুলো এ-রকম :
অপরিচিত কণ্ঠস্বর : হুঁ হুঁ ফিরোজ। ফিরোজ … (অস্পষ্ট)
ফিরোজের কণ্ঠস্বর : না। না। উহুঁ না!
অপরিচিত : লোহার রাডটা কোথায়?
ফিরোজ : জানি না, আমি জানি না।
অপরিচিত : (অস্পষ্টভাবে কিছু বলল)। নিঃশ্বাসের শব্দ।
ফিরোজ : না। না। না।
অপরিচিত : লোহার রড। রড।
ফিরোজ : না। না!
অপরিচিত : (অস্পষ্টভাবে কিছু কথা)। হাসির শব্দ।
মিসির আলি অসংখ্যাবার এই অংশটি বাজিয়ে-বাজিয়ে শুনলেন। অস্পষ্ট অংশগুলো উদ্ধার করতে পারলেন না। অপরিচিত যে-কণ্ঠস্বর শুনছেন, তা ফিরোজেরই কণ্ঠস্বর। এটি তার একটি দ্বিতীয় সত্তা। সেকেণ্ড পারসোনালিটি। ফিরোজকে পুরোপুরি সুস্থ করতে হলে তার দ্বিতীয় সত্তাটিকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।
হানিফা ছটফট করছে। তার জ্বর কমে নি। এখন এক শ দুইয়েরও কিছু বেশি। মিসির আলি চিন্তিত বোধ করলেন। রাত দশটার দিকে জ্বর অনেক কম ছিল। নিরানব্বুই পয়েন্ট পাঁচ। এখন এত বাড়ল কেন?
হানিফা জেগে আছে। কিন্তু কোনোরকম সাড়াশব্দ করছে না। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, খারাপ লাগছে নাকি রে বেটি?
না।
মাথার যন্ত্রণা আছে?
আছে।
বেশি?
জ্বি।
মাথা টিপে দেব?
হানিফা লজ্জিত স্বরে বলল, জ্বি-না।
না কেন? আরাম লাগবে। তার আগে মাথায় পানি ঢেলে জ্বরটা কমাতে হবে।
তিনি বাথরুমে ঢুকলেন পানির বালতির খোঁজে। তাঁর নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। মাথা ভার ভার লাগছে। বমি-বমি লাগছে। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু একটি বাচ্চা মেয়ে জ্বরে ছটফট করবে, আর তিনি শুয়ে থাকবেন–এটা হয় না।
হানিফার এ-বাড়িতে আসার ইতিহাস বেশ বিচিত্র। গত বছর জুলাই মাসের দিকে একবার বেশ বড় একটা ঝড় হল; রাত একটায় জেগে উঠে দেখেন, দড়ামদুডুম শব্দে জানালার পাট আছড়ে পড়ছে। ছাটে ঘর ভেসে যাচ্ছে ইলেকট্রিসিটি নেই। চারদিক অন্ধকার। মোটামুটি একটি ভয়াবহ অবস্থা। তিনি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন, আট ন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে এক-একা দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে।
কে রে তুই?
মেয়েটি ভয়-পাওয়া স্বরে বলল, আমি।
এখানে কী করছিস?
ঘুমাইতাছি।
জেগে জেগে ঘুমাচ্ছিস নাকি?
মেয়েটি জবাব দিল না।
বাপ-মা কোথায়?
মেয়েটি নিরুত্তর!
তোর বাবা-মা নেই।
না।
আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?
না।
তুই কি এ-রকম এক-একা মানুষের বারান্দায় ঘুমোস নাকি?
মেয়েটি জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, ভয় লাগছে না তোর?
না।
বলিস কী! নাম কি তোর?
হানিফা।
আয়, ভেতরে আয়। ইস্, ভিজে জবজবে হয়ে গেছিস তো।
মিসির আলি হারিকেন জ্বালিয়ে তাকালেন মেয়েটির দিকে ছেলেদের মতো ছোটছোট করে কাটা চুল। আদুরে একটা মুখ।
তোর বাপের নাম কি?
জানি না।
বলিস কী! মার নাম?
জানি না।
তোর হাতে কী? মুঠোর ভেতর কী আছে?
হানিফা মুঠি খুলল। ভাংতি পয়সা।
ভিক্ষা করে পেয়েছিস?
হুঁ।
মিসির আলি গুনলেন। দু টাকা ত্রিশ পয়সা। এই বিশাল পৃথিবীতে আগামীকাল এই মেয়েটি যাত্রা শুরু করবে–দুই টাকা ত্রিশ পয়সা, একটা নোংরা ফ্রক এবং একটা তালি দেয়া প্যান্ট নিয়ে। কোনো মানে হয়?
তিনি একটি শুকনো লুঙ্গি বের করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কাপড় বদলে এটা পরে ফেল। নিউমোনিয়া বাধাবি তো! ঐ ঘরে একটা বিছানা আছে, ওখানে গিয়ে শুয়ে থাক।
মিসির আলি ভেবেছিলেন, সকাল হলেই সে চলে যেতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। এক বার যাযাবর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে বন্ধন আর ভালো লাগে না। কিন্তু হানিফা সকালবেলা চলে যাবার কোনো রকম লক্ষণ দেখাল না। এমনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল, যেন এইটি তার ঘরবাড়ি।
হানিফার প্রতি সমাজের যে দায়িত্ব ছিল, মিসির আলি তা পালন করেছেন। নিজেই তাকে পড়তে শিখেয়েছেন। যোগ ভাগ গুণ শিখিয়ে নিয়ে গেছেন স্কুলে ভর্তি করাবার জন্যে। কেউ ভর্তি করাতে রাজি হয় নি। এত বড় মেয়েকে ক্লাস ওয়ানে অ্যাডমিশন দেয়ানো সম্ভব নয়। তিনি হানিফাকে বলেছেন, ঠিক আছে, তুই ঘরে বসেই পড়াশোনা চালিয়ে যা। যথাসময়ে প্রাইভেটে তোকে দিয়ে ম্যাট্রিক দেওয়াব। আমি নিজে তো সব সময় দেখতে পারি না। এক জন মাষ্টার রেখে দেব।