মার কাছ থেকে এসব শুনে আমার খুব মন খারাপ হল। একটি ছেলেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে করতে হবে কেন? বিয়োটা কি এতই জরুরি? আমি ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে বললাম, আমি কখনো, কোনো অবস্থাতেই তোমার এই বন্ধুর সামনে যাব না। ভাইয়া চোখ লাল করে বলল, যেতেই হবে। আমি শান্ত গলায় বললাম, এটা নিয়ে তুমি যদি জোর খাটাও, আমি তাহলে মরে যাব। ভাইয়া চুপ করে গেল। আমি শান্ত ধরনের মেয়ে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ভয়ঙ্কর জেদি। ভাইয়া তা খুব ভালোই জানে। সে আমাকে ঘাটাল না। আমি ভেতরের বাড়িতে থাকতে লাগলাম। ভুলেও বাইরে পা বাড়াই না। তবু এক দিন সন্ধ্যায় দেখা হয়ে গেল। ফিরোজ ভাইকে দেখে মনে হল, তিনি খুব অবাক হয়েছেন। আমি হকচাকিয়ে গিয়েছি। নিজেকে সামলে নিয়ে কোনোমতে বললাম, বড় ঘরে গিয়ে বসুন, সেখানে চা দেয়া হবে।
এই বলে আমি চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছি। পোলিওর জন্যে আমার এক পায়ে কোনো জোর নেই, কাজেই উল্টে পড়ে গেলাম। ফিরোজ ভাই আমাকে টেনে তুললেন। এটাই স্বাভাবিক। এতে লজ্জা বা অপমানের কিছুই নেই। কিন্তু রেগে গেলাম। এবং কঠিন গলায় বললাম, হাত ছাডুন।
তিনি পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেলেন। আমার হাত ছেড়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
মিসির আলি এই চিঠিটা বেশ অনেক বার পড়েছেন এবং প্রতিবারই তাঁর মনে হয়েছে, চমৎকার একটি চিঠি। আন্তরিক এবং কোনো ভান নেই। এক জন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভান করে তার চিঠিতে। যে এই ভানের ওপরে উঠে আসতে পারে, তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হয়।
সুন্দরী একটি মেয়ের মনটাও বোধহয় সুন্দর হয়।
মিসির আলি অন্যমনস্কভাবে খাতার পাতা ওন্টাতে লাগলেন। এখনো পানি আসে। নি। আজ কি বাড়িওয়ালা তার পানির পাম্পটি খুলবে না? ওদের নিজেদের কি পানির দরকার হয় না? দুপুরের খাওয়াদাওয়ারও একটা ব্যবস্থা করতে হয়। রান্নাবান্না কিছু হয়নি। হানিফা জ্বরে কাতর। কালকের ঘটনায় বেচারি বেশ ভয় পেয়েছে। সকালে এক শ এক জ্বর ছিল, এখন এক শ দুই। দুটি প্যারাসিটামল কিছুক্ষণ আগেই খাওয়ানো হয়েছে। জ্বর কমে যাওয়া উচিত, কিন্তু কমছে না। বিকেল নাগাদ না-কমলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
তিনি খাতপত্র গুছিয়ে উঠলেন। উঁকি দিলেন হানিফার ঘরে। হানিফার জন্যে তিনি একটি ঘর দিয়েছেন। এই ঘরে ছোট্ট একটি খাটি আছে, পড়ার চেয়ার-টেবিল আছে, একটি আলনা আছে। এই মেয়েটি কোনোদিন কল্পনাও করে নি, কোনোদিন এতগুলো জিনিস তার হবে।
হানিফা, তোর জ্বর কেমন রে?
ভালো।
মিসির আলি কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন।
ভালো কোথায়? অনেকখানি জ্বর তো! মাথায় পানি ঢালতে হবে।
হানিফা জ্বরতপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল। এই লোকটিকে সে বুঝতে পারছে না। এক জন কাজের মেয়ের জন্যে কেউ এতটা দরদ দেখায়, না দেখান উচিত?
হানিফা।
জ্বি।
জ্বর খুব বেশি। জ্বর নামাতে হবে। পানি তো বোধহয় এক ফোটাও নেই।
জ্বি-না।
যাই, বাড়িওয়ালাকে পাম্প ছাড়তে বলি।
বলেন।
ফিরোজের বাড়ি থেকে কেউ এসেছিল?
জ্বি-না।
টেলিফোন করে একটা খোঁজ দিতে হয়। কী বলিস হানিফা?
জ্বি, নেন!
হানিফা চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার জ্বর বোধহয় বাড়ছে। চোখ ছোট-ছোট হয়ে এসেছে। চোখের সাদা অংশ কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে। মিসির আলি চিন্তিত মুখে বাড়িওয়ালার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
বাড়িওয়ালা করিম সাহেব বাসাতেই ছিলেন। পানি এখনো ছাড়া হয় নি। শুনে তিনি খুব হৈচৈ করতে লাগলেন। বারবার বললেন, এই সামান্য কাজের জন্যে আপনি নিজে আসলেন প্রফেসর সাহেব।–বড় লজ্জায় ফেললেন আমাকে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
মিসির আলি সাহেব বললেন, একটা টেলিফোন করা যাবে করিম সাহেব?
একটা কেন, এক শটা করা যাবে। যখন ইচ্ছা তখন করা যাবে। দরকার হলে ট্রাংকল করবেন–খুলনা ময়মনসিংহ বরিশাল। টেলিফোনের বিল আবদুল করিমকে কিছু করতে পারবে না, বুঝলেন প্রফেসর সাহেব? ওরে, টেলিফোনটা প্রফেসর সাহেবকে এনে দে। আর দেখ, ঠাণ্ডা পেপসি বা সেভেন আপ কিছু আছে কি না।
কিছু লাগবে না।
আপনি না বললেই হবে নাকি? আপনার একটা ইজ্জত আছে না? ছয় মাসে এক বছরে একবার আসেন। আমি বলতে গেলে রোজই বসে থাকি আপনার ওখানে আপনি ফ্যানটার নিচে ঠাণ্ডা হয়ে বসেন তো দেখি।
মিসির আলি বসলেন। বাড়িওয়ালা করিম সাহেব মিসির আলিকে একটু বিশেষ রকম স্নেহ করেন। গত দুবছরে তিনি প্রতিটা ফ্লাটের ভাড়া তিন দফায় বাড়িয়েছেন। শুধু প্রফেসর সাহেবের ভাড়া এক পয়সাও বাড়ে নি। কেন বাড়ে নি কে জানে?
ফিরোজের মাকে টেলিফোনে পাওয়া গেল। তাঁর কাছ থেকে যে-সমস্ত তথ্য জানা গেল, সেগুলো হচ্ছে–ফিরোজ ভালো আছে, সুস্থ এবং স্বাভাবিক। তার ঘরে একটি মাইক্রোফোন বসিয়ে ঘরের যাবতীয় শব্দ টেপ করা হয়েছে। টেপগুলো তিনি সন্ধ্যাবেলা পাঠাবেন।
ফিরোজের মা চিন্তিত স্বরে বললেন, আপনি অসুস্থ বলেছিলেন কেন? আমরা খুব ভয়ে-ভয়ে রাতটা কাটালাম। আপনার ওখানে সে কিছু করেছিল নাকি?
না, তেমন কিছু করে নি। একটু উদভ্ৰান্ত মনে হচ্ছিল। ফিরোজ কি আছে ঘরে?
হ্যাঁ, আছে। কথা বলবেন?
বলব। দিন ওকে।
ফিরোজের গলা শান্ত ও স্বাভাবিক।
কেমন আছ ফিরোজ?
ভালো।
কী করছিলে?
কিছু করছিলাম না। একটা উপন্যাস নিয়ে বসেছিলাম।
কার উপন্যাস?
জন ষ্টেইনবেক। নাম হচ্ছে গিয়ে আপনার, সুইট থার্সডে। স্যার, আপনি পড়েছেন এটা?
গল্প-উপন্যাস আমি পড়িটড়ি না। এক জন লেখকের বানানো দুঃখ-কষ্টের বিবরণ পড়ে কী হয় বল? এমনিতেই আমাদের চারদিকে প্রচুর দুঃখ-কষ্ট আছে।