রাতে খাবার সময় আজমল সহজ স্বরে বলল, নাজের সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে, তাই না? নাজ বলছিল।
ফিরোজ কিছু বলল না। আজমল বলল, ও কিছুতেই তোর সামনে আসতে চাচ্ছিল না। দেখাটা সে-জন্যেই এমন হঠাৎ হয়েছে।
আসতে চাচ্ছিল না কেন?
লজ্জা। ওর পোলিওতে একটা পা নষ্ট। এই লজ্জায় সে কারো সামনে পড়তে চায় না।
আজমলের মুখ কঠিন হয়ে গেল। সে রুক্ষ স্বরে বলল, পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা তার মধ্যে। শুধু তোর সামনে কেন, কারো সামনেই সে যায় না।
সমস্ত রাত ফিরোজ এক ফোঁটা ঘুমতে পারল না। এত কষ্টের রাত তার জীবনে আসে নি। এবং ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটল পরদিন দুপুরে।
সে এক-একা শিয়ালজানি খালের পাড় ধরে হাঁটতে গেল। এবং তার এক ঘন্টার মধ্যেই চার-পাঁচ জন লোক তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। তার চোখ লাল টকটক করছে। দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে! কথাবার্তা অসংলগ্ন। মাঝে-মাঝে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠছে এবং দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে।
আজমল এবং তার মা হতভম্ব। নাজনীন সমস্ত ব্যাপার দেখে অনবরত কাঁদছে। বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে মানুষে। নানান জল্পনা-কল্পনা। খারাপ বাতাস লেগেছে। জিনে ধরেছে। কালীর আছর হয়েছে।
ফিরোজকে নিয়ে আসা হল ঢাকায়। সারিয়ে তুললেন মিসির আলি সাহেব। সেই সারানোর ব্যাপারটা সাময়িক। কিছুদিন সুস্থ থাকে, আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। লোকজনদের গলা টিপে ধরতে চায়। জিনিসপত্র ভেঙে একাকার করে।
তবে এখন অবস্থা অনেক ভালো। অসুস্থতার সময় আগের মতো ভায়োলেন্ট হয় না। চুপ করে থাকে। কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে। ঘর থেকে শুধু বিড়বিড় শব্দ শোনা যায়। যেন সে কারো সঙ্গে কথা বলছে।
যখন সে সুস্থ থাকে, তখন তার অসুস্থ অবস্থার কথা বিশেষ মনে থাকে না। মিসির আলি সাহেব খুটিয়ে খুঁটিয়ে যা বের করেছেন, তা খাতায় লিখে রেখেছেন। লেখা হয়েছে ফরোজের জবানিতে।
অসুস্থতার বিবরণ
সারা রাত নানান কারণে আমার ঘুম হয় নি। শেষ্যরাতের দিকে একটু ঘুম এল। তাও অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। ছাঁটার সময় বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দেখি, আজমল একটা চাদর গায়ে দিয়ে আমবাগানে রোদের জন্যে অপেক্ষা করছে। চট করে রোদ উঠবে মনে হল না। কারণ খুব কুয়াশা। আমি লক্ষ করেছি, আটটা-নটার আগে এ অঞ্চলে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না।
আজমল আমাকে দেখে বলল, আজ এত সকাল-সকল উঠলি যে? চোখ লাল কেন? রাতে ঘুম হয় নি?
হয়েছে।
চা খাবি এক কাপ? নাশতা হতে দেরি হবে। চাল কোটা হচ্ছে, পিঠা হবে; সময় লাগবে।
চা এক কাপ খাওয়া যায়।
চা খেতে-খেতে পাখি শিকার নিয়ে কথা হল। এখান থেকে প্রায় মাইল চারেক দূরে পুকইরা বিলে নাকি খুব হাঁস নামছে। শেষ রাতে উঠে গেলে প্রচুর পাওয়া যাবে। আমি হাস মারার ব্যপারে যথেষ্ট উৎসাহ দেখলাম, কিন্তু আজমলের কাছ থেকে কোনোরকম সাড়া পাওয়া গেল না। অথচ এখানে যার সঙ্গেই দেখা হয়, সেই জিজ্ঞেস করে পাখি শিকার করতে এসেছি কি না। আজমলের এ রকম অনগ্রহের কারণ নাশতা খাবার সময় টের পাওয়া গেল। এদের পাখি মারার কোনো বন্দুক বৰ্তমানে নেই। একটা দোনলা উইনস্টন গান ছিল। অর্থনৈতিক কারণে বিক্রি করে ফেলতে হয়েছে। শিকারের প্রসঙ্গ উঠতেই এই কারণেই আজমল মন খারাপ করেছে। আমার নিজেরও তখন একটু খারাপ লাগল। শিকারের প্রসঙ্গটা না-তুললেই হত।
রোদ উঠল দশটার দিকে। আমি ভেবেছিলাম, আজমলের সঙ্গে বাজারের দিকে যাব। কিন্তু আজমল বলল, তুই থাক, আমি দেখি একটা বন্দুকের ব্যবস্থা করা যায় কি না।
আমি বললাম, বন্দুকের ব্যবস্থা করার কোনো দরকার নেই। শিকারের দিকে আমার কোনো ঝোঁক নেই।
আজমল আমার কোনো কথা শুনল না। সে অসম্ভব জেদি। আমাকে রেখে চলে গেল। আমার তেমন-কিছু করার নেই। শিয়ালজানি খাল ধরে ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
এ—অঞ্চলে হিন্দু বসতি খুব বেশি। এদের ঘর-দুয়ার খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দেখতে ভালো লাগে। তবে অনেক বাড়ি-ঘর দেখলাম ফাঁকা। আজমলের কাছে শুনেছি, অনেক হিন্দু পরিবার একাত্তুরের যুদ্ধে কলকাতা গিয়ে আর ফিরে আসে নি। বেশ কিছু মারা পড়েছে পাকিস্তানি আর্মির হাতে। এদের ঘর-বাড়ি ফাঁকা। বড় বড় ঘাস জন্মেছে। জনমানবশূন্য বাড়ি-ঘর দেখতে কেমন যেন ভয়ভয় লাগে। গা ছমছম করে।
আমি ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে যাব। চড়চড় করে রোদ উঠছে। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। হাঁটতে-হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি। যে—জায়গাটায় আছি, তা অসম্ভব নির্জন। আমি বিশাল একটা বকুলগাছের নিচে দাঁড়ালাম খানিকক্ষণ। তখনই ব্যাপারটা ঘটল। গরগর একটা শব্দ শুনলাম গাছে যেন কেউ গাছের ডাল নাড়াচ্ছে। আমি চমকে গাছের দিকে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল।
দেখলাম, গাছের ডালে এক জন মানুষ বসে আছে। খালি গা। পরনে একটা প্যান্ট। চোখে গোন্ড রিম একটা চশমা। লোকটি রোগা এবং দারুণ ফর্সা। মুখের ভাব অত্যন্ত রুক্ষ। সে সাপের মতো সরসর করে নেমে এল। এক জন মানুষ গাছ থেকে নেমে আসার মধ্যে তেমন অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু আমার শরীর কাঁপতে লাগল। ঘামে গা চটচটে হয়ে গেল। লোকটির দৃষ্টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ চশমার কাঁচের আড়ালেও তার চোখ চকচক করছে। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল আমার দিকে। আমার প্ৰচণ্ড ইচ্ছা করছিল ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু আমার পা যেন মাটিতে লেগে গেছে। নডুবার সামথ্য নেই। লোকটির কাছ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবারও ক্ষমতা নেই। সে এগিয়ে এল আমার দিকে, তারপর একটা চড় বসিয়ে দিল। এর পরের ঘটনা আমার আর কিছুই জানা নেই।