ফিরোজের দুটি হাত পেছন দিকে। সে হাতে সে কী ধরে আছে তা মিসির আলির বুঝতে অসুবিধা হল না। তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন।
কেমন আছ ফিরোজ নীলুর গলা তো চমৎকার ইমিটেট করলে। এস, ভেতরে এস। ইস, ভিজে গেছ দেখি!
ফিরোজ ভেতরে ঢুকল। পলকের জন্যে মিসির আলির ইচ্ছা করল ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি পারলেন না। তাঁর পা পাথরের মতো ভারি হয়ে গেছে। অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করলেন।
কিছু খাবে, ফিরোজ চা খাবে ঠাণ্ডায় চা-টা ভালো লাগবে। ইনফ্যাক্ট আমি চা বানানোর জন্যেই উঠেছিলাম।
ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। সে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সে মাঝেমাঝে ঠোঁট টিপে হাসছে।
মিসির আলি বললেন, বস ফিরোজ, দাঁড়িয়ে আছ কেন এতক্ষণ শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছিলাম। একটা সায়েন্স ফিকশন। তুমি কি সায়েন্স ফিকশন পড়?
ফিরোজ এবার শব্দ করে হাসল। মিসির আলি শিউরে উঠলেন। কী অমানুষিক হাসি! এই হাসির জন্ম নয়, অন্য কোনো ভুবনে অচেনা ভয়ঙ্কর এক ভুবন, যার কোনো রহস্যই আলির জানা নেই। মিসির আলির সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল। তিনি বহু কষ্ট বললেন, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে ফিরোজ?
হ্যাঁ।
কেন ফিরোজ, আমি কি তোমার ক্ষতি করেছি?
ফিরোজ তার জবাব দিল না। লোহার রডটি উঁচু করল। মিসির আলি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল, চিৎকার দিতে পারলেন না। তাঁর কাছে শুধু মনে হল, মোমবাতির আলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এবং আশ্চর্যের ব্যাপার–ছেলেবেলার একটি স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল। গ্ৰীষ্মের প্রচণ্ড গরমের এক দুপুরে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ব্ৰহ্মপুত্রের শীতল জলে। ঠাণ্ডা ও ভরি সেই পানি মাছের চোখের মতো সেই স্বচ্ছ জলে ইচ্ছে করে তলিয়ে যেতে।
মৃত্যুর আগে গত জীবন চোখের সামনে এক বার হলেও ভেসে ওঠে, এটা কি সত্য? হয়তো সত্য। নয়তো হঠাৎ করে ভুলে-যাওয়া শৈশবের এই ছবি চোখে ভাসবে কোন?
মিসির আলি কিছু-একটা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু বলতে পারলেন না। তার আগেই লোহার রড প্ৰচণ্ড বেগে নেমে এল তাঁর দিকে। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথা। এক গভীর শূন্যতা। মিসির আলি বুঝতে পারছেন, তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর চারদিকে সীমাহীন জলরাশি। তিনি কিছু বলতে চেষ্টা করলেন–বলতে পারলেন না।
মিসির আলি। মিসির আলি। তাকাও তুমি। তাকিয়ে দেখ।
মিসির আলি চোখ মেললেন। মোমবাতি জ্বলিছে। আলো এবং আধার। তিনি কি বেঁচে আছেন? নাকি এটা মৃত্যুর পরের কোনো জগৎ? কোনো অদেখা ভুবন?
মিসির। মিসির।
কে কথা বলে? কোথেকে আসছে কিন্নরকণ্ঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু দেখার উপায় নেই। সমস্ত শরীর অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট। এত কষ্টও আছে পৃথিবীতে? কোথায়, ফিরোজ কোথায়?
মিসির। মিসির আলি। আর কোনো ভয় নেই, সে পালিয়ে গেছে? আমি এসেছি। তাকাও, তাকাও আমার দিকে।
কে পালিয়ে গেছে? কে কথা বলছে? কার দিকে তাকাতে বলছে? মিসির আলি তাকাতে গিয়ে ব্যথায় নীল হয়ে গেলেন। মুখ ভর্তি করে বমি করলেন। টকটকে লাল রক্ত এসেছে বমিতে। ফুসফুস ফুটো হয়েছে। পাঁজরের হাড় ঢুকে গেছে। ফুসফুসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই কারণে।
মিসির আলির চোখে জল এসে গেল-এত কষ্ট, এত কষ্ট!
মিসির। মিসির।
কে তুমি?
তাকিয়ে দেখ।
মিসির আলি তাকালেন। যন্ত্রণা এবং ব্যথার জন্যেই কি তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছেন? হেলুসিনেশন? হেলুসিনেশন।
মিসির আলি, আমি কে বল তো।
জানি না, কে।
ভালো করে দেখ, ভালো করে দেখা চোখ নামিয়ে নিচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে থাক, তাতে ব্যথা ভুলে থাকবে। বল আমি কে?
মিসির আলি আবার মুখ ভৰ্তি করে বমি করলেন।
আমিই সেই দেবী। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস কর না। নাকি এখন করছ?
তুমি আমার কল্পনা। উইশফুল থিংকিং। দেবী আবার কী?
আমিই কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়েছি।
দেবীমূর্তি খিলখিল করে হেসে উঠল। কী চমৎকার হাসি। কী অপূর্ব সুরধ্বনি! ঘরে চাঁপা ফুলের গন্ধ,তীব্র সৌরভ। হেলুসিনেশন! হেলুসিনেশন হচ্ছে। হেলুসিনেশন ছাড়া এ আর কিছুই নয়।
দেবী হাসল। চাঁপা ফুলের গন্ধু কি দেবীর গা থেকেই আসছে? তাকে রক্তমাংসের মানবীর মতোই লাগছে। ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কী কষ্ট! কী কষ্ট! মিসির আলি হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, দেবী, আমার কষ্ট কমিয়ে দাও।
আমাকে বিশ্বাস করছি তাহলে?
না।
কেন করছ না? এ জগতের সমস্তই কি যুক্তিগ্রাহ্য? এই আকাশ, অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ? তুমি কি বলতে চাও, এর কোথাও কোনো রহস্য নেই? অসীম কী? এই সামান্য প্রশ্নের জবাব কি তোমার জানা আছে? বল, তুমি জান?
আজ জানি না, কিন্তু একদিন জানব। আমি না জানলেও আমার পরবর্তী বংশধর জানবে।
মিসির আলি, তুমি বড় অদ্ভুত লোক।
মিসির আলি কাতর কণ্ঠে বললেন, আমার ব্যথা কমিয়ে দাও, আমার ব্যথা কমিয়ে দাও।
দেবী হেসে উঠল। মৃদু স্বরে বলল, আমায় বিশ্বাস করছ না, অথচ ব্যথা কমিয়ে দিতে বলছ?
বড় কষ্ট, বড় কষ্ট!
তোমার বন্ধু চলে আসছে। তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তুমি আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। এবং মজার ব্যাপার কি জান? নীলুর সঙ্গে বিয়ে হবে তোমার। যদি কোনোদিন হয়, আমার কথা মনে করো।