খাবার টেবিলে ভাত সাজিয়ে ওসমান সাহেব ফিরোজের ঘরের চাবি খুললেন। ফিরোজ বেরিয়ে এল। তার হাতে লোহার রড। তার পরনে একটি কালো প্যান্ট, খালি গা। সে থমথমে গলায় বলল, কি, ভয় লাগছে? ভয়ের কিছু নেই। মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি ও আমার চিকিৎসা করবে।
ওসমান সাহেব একটি কথাও বলতে পারলেন না। ফিরোজ হেঁটে-হেঁটে গেল গেটের কাছে দারোয়ানকে ঠাণ্ডা গলায় কাল গেট খুলে দিতে। দারোয়ান গেট খুলে দিল।
টপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমতে শুরু করেছে। রাস্তায় কেন যে স্ট্রীট-লাইট নেই! ফিরোজ লম্বা-লম্বা পা ফেলে অন্ধকারে নেমে গেল!
জাহিদ সাহেব ডাক্তার ডেকে আনলেন
বুধবার।
জাহিদ সাহেব রাত এগারটার দিকে এক জন ডাক্তার ডেকে আনলেন।
নীলুর আকাশ-পাতাল জ্বর। তিনি নিজে হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। ডাক্তারের অবস্থাও তাই। ডাক্তার মুখ শুকনো করে বলল, এই মেয়েকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে। আমি আমার ডাক্তারি জীবনে এত জ্বর কারো দেখি নি। আপনি মেয়েটির মাথায় বরফ চাপা দেবার ব্যবস্থা করুন। আগে টেম্পরেচার কমাতে হবে।
ফ্রীজে বরফ ছিল না। তারা দু জন ধরাধরি করে নীলুকে বাথরুমে নিয়ে ঝরনার কল খুলে দিল। পানির ধারার স্রোতে যদি গায়ের তাপ কমানো যায়।
নীলু পড়ে আছে মড়ার মতো। তার চোখ রক্তবর্ণ। সে কিছুক্ষণ পরপরই মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে এবং ফিসফিস করে বলছে, স্যারের বড় বিপদ! তুমি কি তাকে দেখবে না? এইটুকু কি তুমি আমার জন্য করবে না?
জাহিদ সাহেব ডাক্তণরকে বললেন, এই সব কী বলছে ডাক্তার সাহেব?
প্ৰলাপ বকছে। ডেলিরিয়াম। আপনি মেয়ের কাছে থাকুন, আমি অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে যাচ্ছি। টেলিফোন আছে তো?
জ্বি আছে। বসার ঘরে।
ডাক্তার সাহেব দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। নীলু কাতর স্বরে বলল, বাবা, তুমি খানিকক্ষণ আমাকে একা থাকতে দাও। আমি গুর সঙ্গে কথা বলি।
কার সঙ্গে কথা বলবি?
যে আমার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে। ওর সাহায্য আমার ভীষণ দরকার। বাবা, প্লীজ। প্লীজ। তুমি আছ বলে সে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছে না। বাবা, আমি তোমার পায়ে পড়ি।
নীলু সত্যি সত্যি হাত বাড়িয়ে বাবার পা স্পর্শ করল। জাহিদ সাহেব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন এবং সঙ্গে-সঙ্গেই চাঁপা ফুলের তীব্র সুবাস পেলেন।
স্পষ্ট শুনলেন নূপুর পায়ে কে যেন হাঁটছে। নীলুর কথাও শোনা যাচ্ছে, আমার এত বড় বিপদে তুমি আমাকে দেখবে না?
অপরিচিত একটি কণ্ঠ শোনা গেল। জাহিদ সাহেব কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি একমনে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলেন।
অপরূপা নারীমূর্তি
বুধবার মধ্যরাত্রি।
মিসির আলির রুটিনের ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। ঘরে রান্না হয় নি। তাঁকে রাতে হোটেলে খেয়ে আসতে হয়েছে। ডাল-গোশত নামের যে খাদ্যটি তিনি কিছুক্ষণ আগে গলাধঃকরণ করেছেন, তা এখন জানান দিচ্ছে মিসির আলি পেটে ব্যথা নিয়ে জেগে। আছেন। ফুড পয়জনিং-এর লক্ষণ কি না কে জানে? পেটের ব্যথা ভুলে থাকবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে থ্রিলারজাতীয় কোনো রচনায় মনোনিবেশ করা। কিন্তু ঘরে এ জাতীয় কোনো বই নেই। তবু মিসির আলি বুকসেলফের কাছে গেলেন। সবই একাডেমিক বই। একটি সায়েন্স ফিকশন পাওয়া গেল–Horseman from the sky. তেমন কোনো ইন্টারেষ্টিং বই নয়। আগে এক বার পড়েছেন। তবুও সেই বই হাতে নিয়েই বিছানায় গেলেন এবং তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বৃষ্টি ও বাতাস দুই-ই থেমে গেছে, তবুও। মাঝরাতে লোড় শেডিং হবার কথা নয়, কিন্তু ঢাকা শহরের ইলেকট্রিসিটির কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
মিসির আলি অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ড্রয়ার খুললেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ড্রয়ারে বড় বড় দুটি মোমবাতি পাওয়া গেল। হানিফা নিশ্চয়ই একসময় কিনে রেখে দিয়েছে। মিসির আলি মোমবাতি জ্বালিয়ে বই খুললেন। দ্বিতীয় বার পড়বার সময় বইটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শারীরিক ব্যথা ভুলে আগ্রহ নিয়ে বইয়ের পাতা শুন্টতে লাগলেন। চমৎকার লেখা—এক ভোরবেলায় মস্কো শহরের প্রাণকেন্দ্ৰে এক ঘোড়সওয়ারের আগমন হল। লোকটির চেহারা কুৎসিত। মাথায় সার্কাসের ক্লাউনের টুপির মতো এক টুপি। সে তার ঘোড়া নিয়ে নানান খেলা দেখাতে শুরু করল। দেখতে দেখতে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল।
এত মজার একটি বই আগের বার পড়তে এত বাজে লাগছিল কেন। মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন–চা বানাবেন। চা খেতে-খেতে আরাম করে পড়া যাবে। তাঁর মনে হল, মোমবাতির আলোয় বই পড়ায় আলাদা একটা আনন্দ আছে। আধো আলো আধো ছায়া। বইয়ের জগৎটিও তো তাই–অন্ধকার এবং আলোর মিশ্ৰণ। লেখকের কল্পনা হচ্ছে আলো, পাঠকের বিভ্রান্তি হচ্ছে অন্ধকার। নিজের তৈরি উপমা নিজের কাছেই চমৎকার লাগল। তাঁর। তিনি নিজেকে বাহবা দিয়ে সিগারেটের জন্যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই দরজায় খুব হালকাতাবে কে যেন কড়া নাড়ল!
মিসির আলি ঘড়ি দেখলেন, রাত প্ৰায় একটা। এত রাতে কে আসবে তাঁর কাছে! তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, কে, কে?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। মিসির আদি গলা উঁচিয়ে বললেন, কে এখানে।
আমি।
মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। নীলুর গলা। সে এত রাতে এখানে কী করছে পাগল নাকি!
কি ব্যাপার নীলু?
নীলু জবাব দিল না। ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। মিসির আলি ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন–নীলু নয়, ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে।