মিসির আলি ওদের সামনে থেকে সরে গেলেন। বাইরের এক জনের উপস্থিতি হয়তো এদের কাছে ভালো লাগবে না।
তাঁরা চলে গেলেন। পনের মিনিটের মধ্যে। যাবার আগে মিসির আলি বললেন, ওর জিনিসপত্রগুলি নিয়ে যান। ভদ্রমহিলা কঠিন স্বরে বললেন, কোনোকিছুই নেবার প্রয়োজন নেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যাবার আগে এস. আকন্দ সাহেব অত্যন্ত শুকনো গলায় এক বার শুধু বললেন, আমাকে কষ্ট করে খুঁজে বের করবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। ব্যস, এইটুকুই।
মিসির আলি ভেবে পেলেন না, এরা তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ কেন করলেন। তাঁদের মেয়েটি তার বাসায় গৃহভৃত্য ছিল, এইটিই কি তাঁদের মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে? এত বিচিত্র কেন মানুষের মন!
অবশ্যি তাঁদের বিচিত্র আচরণের অন্য একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করানো যেতে পারে। হয়তো আজকের এই ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা হকচাকিয়ে গেছেন। আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা এসে পড়েছে। এ-কারণেই।
মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হানিফা নামের মেয়েটির জন্যে খারাপ লাগছে। বেশ খারাপ লাগছে। মেয়ে জাতটাই হচ্ছে মায়াবতীর জাত। কখন যে এই মেয়েটি মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে, নিজেই বুঝতে পারেন নি।
হানিফার সঙ্গে তাঁর আর কোনোদিন দেখা হবে না। ওঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের মেয়েকে নিয়ে এখানে আসবেন না। তিনি নিজেও যাবেন না। কারণ তিনি কোনো পিছুটান রাখতে চান না কিংবা কে জানে, একদিন হয়তো যাবেন! দেখবেন, ঝড়ের রাতে পাওয়া ভিখিরি মেয়েটিকে রাজরানীবেশে কেমন লাগছে। সে কি মনে রাখবে তার দুঃসহ শৈশব? যদি রাখে, তবেই সে জীবনে অনেক বড় হবে। এবং তার ধারণা, এই মেয়েটি তা মনে রাখবে।
মিসির আলি চোখ মুছে নিজের ঘরে ঢুকলেন। বারবার চোখ ভিজে উঠছে কেন? তাঁর মতো এক জন শুকনো ধরনের মানুষের হৃদয়ে এত ভালবাসা কোথেকে এল?
দরজায় নক হচ্ছে। কে এল এত রাতে?
মিসির আলি দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখলেন–আকন্দ সাহেব! তাদের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। তিনি শুধু একা নেমে এসেছেন। মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার!
বাসার কাছাকাছি পৌঁছার পর মনে হল, আপনাকে আমি যথাযথ ধন্যবাদ দিই নি।
ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
আপনার নেই। আপনি সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্ব। কিন্তু আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ।
ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন মিসির আলিকে এবং ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী হানিফাকে নিয়ে নেমে এসেছেন গাড়ি থেকে। তিনি শক্ত করে হানিফার হাত ধরে রেখেছেন, যেন হাত ছেড়ে দিলেই মেয়েটি পালিয়ে যাবে।
মিসির আলি কোমল স্বরে বললেন, শান্ত হোন। আপনি শান্ত হোন। আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি।
ভদ্রলোক ধরা গলায় বললেন, প্লীজ, আরো কিছুক্ষণ আপনাকে জড়িয়ে রাখার সুযোগ দিন। প্লীজ।
ওসমান সাহেবের ঘুমের সময়
বুধবার। সময় রাত দশটা চল্লিশ।
ওসমান সাহেবের ঘুমের সময় হয়ে গিয়েছে। ইদানীং তিনি সিডাকসিন না খেয়ে ঘুমাতে পারেন না। তিনি উঠলেন। একটি সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে মাথায় পানি ঢাললেন, হাত-মুখ ধুলেন। বিছানায় যাবার আগে রোজকার অভ্যোসমতো উঁকি দিলেন ফিরোজের ঘরে। গত তিন দিন তিন রাত ধরে ফিরোজ তার ঘরে আটকা দু দিন দু রাত সে ছটফট করেছে, জিনিসপত্র ভেঙেছে, খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সারাদিন তেমন কিছু করে নি। ভাতটাত কিছুই খায় নি, তবে কোনো রকম চিৎকার এবং হৈচৈ করে নি। এখন সম্ভবত করবে। রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার পাগলামি বাড়ে, অস্থিরতা বাড়ে।
ওসমান সাহেব ফিরোজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ অবাক হলেন। ফিরোজ শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। গায়ে একটি শার্ট। চুল আচড়িয়েছে। মুখভর্তি খোঁচা-খোচা দাড়ি নেই শেত করেছে। এবং সম্ভবত গোসলও করেছে। ওসমান সাহেব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
কেমন আছ ফিরোজ?
ফিরোজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এবং সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ বাবা?
ভালো, ভালো। আমি ভালো, বেশ ভালো।
ওসমান সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কী অদ্ভুত কান্ড। ফিরোজ কি সুস্থ? নিশ্চয়ই সুস্থ।
বাবা, মাকে ডাকা খিদে পেয়েছে, তাত খাব।
নিশ্চয়ই খাবি, নিশ্চয়ই। কী দিয়ে খাবি?
যা আছে, তাই দিয়ে খাব। স্পেশাল কিছু লাগবে না।
লাগবে না কেন? নিশ্চয়ই লাগবে। দাঁড়া ডাকছি। তোর মাকে ডাকছি। তোর শরীরটা এখন ভালো, তাই না?
হ্যাঁ, ভালো। বাবা, আমার ঘরটা খুব নোংরা হয়ে আছে, একটা ঝাড়ু দিতে বল। তালা খোলার দরকার নেই। জানালা দিয়েই দাও।
ওসমান সাহেব ঝাড়ু এনে দিলেন এবং ছুটে গেলেন স্ত্রীকে খবর দিতে। ফরিদাঁকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে এনে দেখেন, ফিরোজ ঘর মোটামুটি পরিষ্কার করে ফেলেছে। কত সহজ এবং স্বাভাবিক তার ব্যবহার! ফরিদার চোখে পানি এসে গেল।
মা, ভাত দাও আমাকে। খুব খিদে লেগেছে।
দিচ্ছি। বাবা, দিচ্ছি। এক্ষুণি দিচ্ছি।
জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে দিও না মা। নিজেকে জন্তুর মতো লাগে। মনে হয় আমি চিড়িয়াখানার একটা পশু।
না না, জানালা দিয়ে খাবার দেবনা। টেবিলে খাবার দিচ্ছি। দুই চেয়ার-টেবিলে বসে খাবি।
আর শোন মা, আমার বিছানার চাদর-টাদর বদলে দাও। ধবধবে সাদা চাদর দেবে।
দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি।
আনন্দে ফরিদা বারবার মুখ মুছতে লাগলেন। সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কোনো সমস্যা নেই, তাদের দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়েছে।