জাহিদ সাহেব বললেন, কী হচ্ছে এ-সব! কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
ও তুমি বুঝবে না বাবা।
বুঝব না মানে? বুঝব না মানে কী?
অনেক কথা বাবা পরে তোমাকে বলব।
না, এখনি শুনব।
নীলু বলল, এবং নীলুর কথা তিনি কিছুই বুঝলেন না। একজন- কেউ নীলুর সঙ্গে আছে–যে নীলুকে তার মহাবিপদ থেকে রক্ষা করেছিল। কী অদ্ভুত কথা!
জাহিদ সাহেব দারুণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে লাগলেন। তাঁর ধারণা হল, নীলুর বড় কোনো অসুখ হয়েছে। তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললেন। দু জন পীরের কাছ থেকে তাবিজ আনালেন। সেইসব তাবিজ পরতে নীলু। কোনো আপত্তি করল না। ডাক্তারদের অষুধপত্র খেতেও তার কোনো অনীহা দেখা গেল না। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না। এবং হবেও না কোনোদিন। তাঁর বাকি জীবন কাটবে অদ্ভুত এই নীলুকে সঙ্গে নিয়ে– যাকে তিনি চেনেন না, বোঝেন না। যে মনের কথা বুঝে ফেলে। যার ঘরে অপরিচিত এক রমণীকণ্ঠ শোনা যায় এবং দমকা হাওয়ার মতো চাঁপা ফুলের গাঢ় গন্ধ যাকে হঠাৎ ঘিরে ফেলে।
আজ বুধবার। আকাশে মেঘ নেই। রৌদ্রোজ্জ্বল একটি সুন্দর সকাল। জাহিদ সাহেব অনেক দিন পর উৎফুল্ল বোধ করলেন। তাঁর মনে হল, দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে। নীলু ভালো হয়ে যাবে। তাঁর চমৎকার একটি বিয়ে হবে। ছেলেপুলে আসবে তাদের সংসারে। সেই সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর শেষজীবন ভালোই কাটবে। এক জন মানুষ তো সারা জীবন দুঃখী থাকতে পারে না। দুঃসময়ের পর আসে সুসময়। জীবনচক্রের এই এক কঠিন নিয়ম। তবে কারো-কারো ক্ষেত্রে দুঃসময়টা দীর্ঘ হয়, এই যা। যেমন তাঁর হয়েছে।
জাহিদ সাহেব ডাকলেন, নীলু, নীলুম। অনেক দিন পরে তাঁর কণ্ঠে আনন্দ ঝরে পড়ল।
এল না। তিনি উঁকি দিলেন নীলুর ঘরে। তার ঘর অন্ধকার। দরজা জানালা বন্ধ। পদ টেনে দেয়া, ঘরের বাতাস ভারি হয়ে আছে।
কী হয়েছে নীলু?
কিছু হয় নি।
এভাবে শুয়ে আছিস কেন? শরীর ভালো না?
তিনি নীলুর কপালে হাত দিলেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নীলুর চোখ-মুখ রক্তবর্ণ।
তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, কী হয়েছে মা?
কিছু হয় নি।
কিছু হয় নি মানে? তোর গায়ে তো প্রচণ্ড জ্বর। কখন জ্বর এল? ডাক্তার ডাকা দরকার। এক্ষুণি দরকার।
বাবা, এই নিয়ে তুমি ভাববে না। কাউকে ডাকার দরকার নেই।
দরকার নেই, বললেই হল!
বাবা, তোমায় পায়ে পড়ি! আমাকে একা থাকতে দাও। বিরক্ত করো না। ভয় নেই, জ্বর সেরে যাবে।
জাহিদ সাহেব লক্ষ্য করলেন, নীলু কাঁদছে।
মা, কী হয়েছে তোর?
কিচ্ছু হয় নি বাবা। আমি সেরে যাব। আমি আবার আগের মত হব। যে আমার সঙ্গে থাকত, সে আমাকে বলেছে।
সে কে?
আমি নিজেও জানি না, সে কে এক মহাবিপদে সে আমাকে রক্ষা করেছিল। বাবা, তুমি যাও!
জাহিদ সাহেব মুখ কালো করে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। চমৎকারভাবে যেদিনটি শুরু হয়েছিল, সেটি খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। তিনি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে এক-এক বারান্দায় বসে রইলেন।
কাজের মেয়ে
বুধবার। সময় সাতটা দশ।
সন্ধ্যার ঠিক পরপর মিসির আলি নিউ ইস্কাটন রোড়ের যে তিনতলা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তার নাম–নিকুঞ্জ। লোকজন বিশাল প্রাসাদ তৈরি করে নাম দেয়–কুটির। এ-রকম বাড়ির নাম কেউ কুটির রাখে?
বাড়ির সামনে ফুটবলের মাঠের মতো বড় লন। লনের ঘাস বড়-বড় হয়ে আছে। লদের চারদিকে একসময় ফুলের বাগান ছিল। এখন নেই। শ্বেতপাথরের একটি শিশুমূর্তি (সম্ভবত ফোয়ারা) আছে মাঝখানে, তাতে শ্যাওলা পড়েছে। চারদিকে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ।
মিসির আলির মনে হল——এ বাড়ির মালিক দেশে থাকেন না। চাকর বাকরের হাতে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে তিনি থাকেন বিদেশে। হঠাৎ—হঠাৎ আসেন, আবার চলে যান। মিসির আলি খানিকটা শঙ্কিত বোধ করলেন। বাড়ির মালিক এস. আকন্দ সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া খুবই জরুরি। কারণ মিসির আলির ছাত্র শেষ পর্যন্ত ইমা নামের একটি মেয়ের খবর পত্রিকায় পেয়েছে। খবরের শিরোনাম–হারিয়ে গেল ইমা। ডল হাতে তিন বছর বয়সী একটি বালিকার ছবি আছে। খবরের সঙ্গে।
মেয়েটি তার বাবা-মা’র সঙ্গে ঢাকা থেকে খুলনা যাচ্ছিল। খুব চঞ্চল মেয়ে। সারাদিন ছোটাছুটি করেছে। স্ট্রীমারে উঠে তার খুব ফূর্তি। এক জন আয় তার সঙ্গে সঙ্গে। বরিশাল থেকে স্টীমার ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই আয়া দেখল, ইমা নেই। সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে এক-একা নিচে নেমে গেছে? সে ছুটে এল নিচে। সেখানেও ইমা নেই। সে কি রেলিং টপকে নদীতে পড়ে গেছে? আয়া ভয়ে-আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেল। ইমার বাবা-মা তখনো কিছু জানেন না। তাঁরা টেলিস্কোপিক লেন্স লাগিয়ে দূরের একটি মাছধরা নৌকার ছবি তোলার চেষ্টা করছেন।
এ জাতীয় বাড়িগুলোতে সাধারণত দারোয়ান এবং কুকুর থাকে। কিন্তু এ-বাড়িতে দুটাের কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। মিসির আলি অনেকটা দ্বিধা নিয়েই গেটের ভেতর ঢুকলেন। কলিং-বেল থাকার কথা, তাও চোখে পড়ছে না। তবে বাড়িতে লোক আছে। আলো জ্বলছে।
আচ্ছা, এ-রকম হওয়া কি সম্ভব যে, এ-বাড়িতে এস. আকন্দ নামের কেউ থাকেন না। এক কালে ছিলেন, এখন নেই। কিংবা খবরের কাগজে যে এস. আকাদের কথা আছে, ইনি সেই ব্যক্তি নন।
হওয়া অসম্ভব নয়। তবে সাজ্জাদ হোসেন বেশ জোর দিয়েই বলেছেন—এটিই ঠিকানা। খবরের কাগজের কাটিং থেকে ঠিকানা বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সাজ্জাদ হোসেনকে। এটি মনে হচ্ছে তিনি ঠিকই করেছেন।