ওসমান সাহেব বললেন, মিসির আলি সাহেব, আপনি চলে আসুন।
আপনি বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি আসছি।
তুই যাচ্ছিস না কেন? কথাগুলো শুনতে মজা লাগছে? তোর ইয়ে— (কিছু কুৎসিত কথা)।
মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ফিরোজ, চুপ কর।
ঠিক আছে, চুপ করলাম। তুই আজ রাতে কোথায় থাকবি?
বাসাতেই থাকব।
তাহলে দেখা হবে।
না, দেখা হবে না। বাথরুমের ভেন্টিলেটার বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ফিরোজের কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করল। চেয়ার ভাঙলি, লাথির পর লাথি বসাতে লাগল পালঙ্কে। কাপ-বাটি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। চোখে দেখা যায় না, এমন ব্যাপার। ভয়াবহ উন্মত্ততা! মনে হয় না এ কোনো দিন শান্ত হবে। মিসির আলি একটি সিগারেট ধরলেন। ফিরোজ চাপা গলায় গর্জন করছে। ক্রুদ্ধ পশুর গর্জন। সমস্ত আবহাওয়াই দূষিত হয়ে গেছে। নরকের একটি ক্ষুদ্র অংশ নেমে এসেছে এখানে।
মিসির আলি দাঁড়িয়ে-থাকা লোকদের বললেন, তোমরা যাও। বারান্দার বাতি নিতিয়ে দাও। ও আপনা-আপনি শান্ত হবে।
নাজনীন
নাজনীন একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নটি দেখেছে ছাড়া-ছাড়াভাবে। তবু সব মিলিয়ে একটা অর্থ দাঁড় করানো যায়। এবং অর্থটি ভয়াবহ। নাজনীন দেখেছে–একটা ছোট ঘরের এক প্রান্তে একটি বিছানা। বিছানাটিতে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে এক জন লোক শুয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আরেক জন লোক ঘরে ঢুকল। লোকটার হাতে একটা লোহার রড। লোকটি টান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা লোকটির ওপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেলল। লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছে এবং সেটি একটি পরিচিত মুখ–মিসির আলির মুখ। স্বপ্নের মধ্যেই প্রচণ্ড একটা শব্দ হল, এবং দেখা গেল মিসির আলির মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
নাজনীন জেগে উঠল চিৎকার করে। স্বপ্ন এত ভয়াবহ হয়! নাজনীন বাকি রাতটা আর ঘুমুতে পারল না। ছ রাকাত নফল নামাজ পড়ল। কোরান শরিফ পড়ল। মন শান্ত হল না। নাজনীনের মা বললেন একটা ছদকা দিয়ে দিতে। প্ৰাণের বদলে প্ৰাণ। সেই ছদকা তো ভোর না-হবার আগে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই কঠিন। নাজনীন ফুপিয়ে-ফুপিয়ে খানিকক্ষণ কদল। সে জানে এটা স্বপ্ন। স্বপ্ন। কখনো সত্যি হয় না। তবু এমন লাগছে কেন?
ভোর হবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে একটি টেলিগ্রাম পাঠাল, সাবধান থাকবেন! টেলিগ্রামটি পাঠিয়েই মনে হল, এর অর্থ তো উনি কিছুই বুঝবেন না। তিন ঘন্টা পর দ্বিতীয় একটি টেলিগ্ৰাম করল। এই টেলিগ্রামটি বেশ দীর্ঘ।
চাচা, আপনার সম্বন্ধে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। একটি লোক লোহার রড দিয়ে আপনার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনাকে অনুরোধ করছি, সাবধানে থাকবেন।
নাজনীন।
এ এক অচেনা নীলু
নিজের মেয়েকে চিনতে না পারার মতো কষ্টের কি কিছু আছে? জাহিদ সাহেব বসেবসে তাই ভাবেন। তাঁর বড় অস্থির লাগে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এ-রকম হবে, জানতেন। দুই মেয়ে বড় হবে–এদের বিয়ে হবে, আলাদা জীবন হবে। তিনি পড়ে থাকবেন একা। এ-অবস্থা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন! পুরোপুরি সে-রকম অবশ্যি হয় নি। এক মেয়ে তাঁর সঙ্গেই আছে। কিন্তু এই মেয়েকে তিনি চেনেন না। এ এক অচেনা নীলু।
আজ দুপুরে খেতে গিয়ে দেখেন, মাংসের ভূনা তরকারি এবং খিচুড়ি করা হয়েছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আজ খিচুড়ি যে!
নীলু বলল, তুমি খেতে চেয়েছিলে, তাই।
জাহিদ সাহেব খেতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কাউকে সে-কথা বলেন নি। নীলুর সঙ্গে গতকাল রাত থেকেই তাঁর কোনো কথা হয় নি! অথচ সে ঠিকই জানল। শুধু আজই নয়, এ-রকম প্রায়ই হয়। বড় অস্বস্তি লাগে। শুধু অস্বস্তি নয়, একটু ভয়ভয়ও করে। একেক রাতে ভয়টা অসম্ভব বেড়ে যায়। কেন বাড়ে, তাও তিনি জানেন না। তাঁর ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যান। যেখানে কেউ তাঁর কোনো খোঁজ পাবে না।
প্রথম এ রকম হল বিলুর বিয়ের চার দিন পর। বিলু নেই। বিয়েবাড়ির আত্মীয়স্বজনরা সব চলে গেছে। বাড়ি একেবারেই খালি। মনটন খারাপ করে জাহিদ সাহেব নিজের ঘর ছেড়ে ঘুমাতে গেলেন নীলুর পাশের ঘরে। এক জন কেউ থাকুক। আশেপাশে, যাতে ডাকলে সাড়া পাওয়া যায়।
অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম এল না। সামনের জীবন কেমন কাটবে, তাই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মৃত স্ত্রীর কথা মনে করে খানিকক্ষণ কাঁদলেন। প্রথম জীবনে একটি ছেলে হয়েছিল–দেড় বছর বয়সে মারা যায়। মিষ্টি কথা বলত। পাখিকে বলত বাকি। ফুলকে বলত কুল। অনেক দিন পরে মৃত ছেলের কথা মনে করেও চোখ মুছলেন। আর ঠিক তখন এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। চাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধে অভিভূত হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী ফুলের গন্ধ আসছে কোথেকে? তাঁর নিজের এক সময় বিরাট ফুলের বাগান ছিল। সে-সব আর কিছু নেই। বাগান জঙ্গল হয়েছে।
জাহিদ সাহেব অবাক হয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই নূপুরের শব্দ শুনলেন!! খুব হালকা, কিন্তু স্পষ্ট। এর মানে কী? তিনি নীলুর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য নীলু যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। গভীর রাতে কে এসেছে নীলুর ঘরে? জাহিদ সাহেব ভয়ার্ত গলায় ডাকলেন, নীলু, ও নীলু।
নীলু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দরজা খুলল।
কার সঙ্গে কথা বলছিস?
আছে এক জন। তুমি চিনবে না।
জাহিদ সাহেব ঘরে উঁকি দিলেন। কাউকে দেখতে পেলেন না। নীলু বলল, ঘুমিয়ে পড় বাবা। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?