মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন এবং সহজ স্বরে বললেন, চলুন, ফিরোজের ঘরটা দেখে আসি।
আপনি একাই যান, আমি যাব না।
আপনি যাবেন না কেন?
আমার সহ্য হয় না। আমি নিজেও পাগল হয়ে যাব।
মিসির আলি একই রওনা হলেন।
ফিরোজের ঘর নিঃশব্দ। সে এই গরমেও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিসির আলি চমকে উঠলেন। মুখভর্তি খোঁচা-খোচা দাড়ি-গোঁফ। গালের হনু উচু হয়ে আছে। সেই উজ্জ্বল গৌরবর্ণের কিছুই নেই, কেমন কালি মেরে গেছে। মিসির আলি লক্ষ করলেন, ফিরোজের হাতের নখ বড় বড় হয়েছে। নখের নিচে ময়লা জমে দেখাচ্ছে শকুনের নখের মতো। ঘুমের মধ্যেই ফিরোজ পাশ ফিরল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, সে হয় করে ঘুমাচ্ছে এবং মুখ দিয়ে লালা পড়ে বিছানার একটা বেশ বড় অংশ চটচটে হয়ে আছে। কুৎসিতু একটা দৃশ্য!
ঘরের একটিমাত্র দরজা, সেখানে সত্যি-সত্যি বিরাট একটা তালা ঝুলছে। দু দিকে দুটি বিশাল জানোলা। জানালায় লোহার গ্রিল। সেই গ্রিল ভেঙে বের হওয়া অসম্ভব। সুস্থ মানুষ দূরের কথা, এক জল পাগলও সেই চেষ্টা করবে না।
মিসির আলি বসার ঘরে ফিরে এলেন। ওসমান সাহেব বললেন, ঘর যে বন্ধ, এটা আপনার বিশ্বাস হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে।
এখন বলুন সে কীভাবে বের হয়?
ফিরোজের ঘরের সঙ্গে একটা এ্যাটাচ্ড্ বাথরুম আছে। বাথরুমের ভেতরটা আমি দেখতে পাই নি। তবে আমার ধারণা, বাথরুমে বেশ বড় একটি ভেন্টিলেটার আছে, এবং ফিরোজ সেই ভেন্টিলেটার দিয়ে বের হয়।
ওসমান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, সিগারেট ধরাতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপছে। মিসির আলি বললেন, এক্ষুণি আপনি ভেন্টিলেটার বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। আজ রাতে যেন সে বের হতে না পারে।
হ্যাঁ, করছি।
আমি এখন চলে যাব। কিন্তু কাল ভোরে আবার আসব। আপনার দারোয়ানকে বলে দিন, যাতে সে আমাকে ঢুকতে দেয়।
হ্যাঁ, আমি বলব। মিসির আলি সাহেব।
বলুন।
আমার ছেলে কি কোনোদিন সুস্থ হয়ে উঠবে?
নিশ্চয়ই হবে। হতেই হবে।
এত রাতে আপনি বাড়ি গিয়ে কি করবেন? থেকে যান এখানে।
না, থাকতে পারব না। আমার সঙ্গে একটা ছোট মেয়ে থাকে, সে এক ভয় পাবে। আপনি দেরি না করে ভেন্টিলেটারটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন।
করছি। এক্ষুণি করছি।
ফরিদা ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মনে হল। তাঁর কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম, এবং তিনি কাপছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ফরিদা থেমে বললেন, মিসির আলি সাহেব, ফিরোজ জেগেছে। আপনাকে ডাকছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
কেমন আছ ফিরোজ?
ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
মিসির আলি চমকে উঠলেন। ভারি গভীর গলায় কথা বলছে ফিরোজ। চোখে-মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি। সে পায়ের ওপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছে।
তুই তুই করে বলছি বলে রাগ করছিস না তো? তুই তো আবার প্রফেসর মানুষ।
রাগ করছি না, তবে দুঃখিত হচ্ছি। সবাইকে সবার প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিত।
তা উচিত। কিন্তু মুশকিল কি জানিস, সারা জীবন তুই ছাড়া কোনো সম্বোধন করিনি। আমাকে চিনতে পারছিস তো? তুই তো গিয়েছিলি আমাদের বাড়িতে।
মিসির আলি চুপ করে রইলেন!! যে কথা বলছে, সে ফিরোজ নয়। ফিরোজের দ্বিতীয় সত্তা। সেকেন্ড পার্সোনালিটি।
কি রে, চুপ করে আছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস? হা হা হা!
না, ভয় পাচ্ছি না।
খাঁচায় আটকে রেখেছিস, ভয় পাবি কেন? ছেড়ে দে, তারপর দেখি তোর কত সাহস!
আমার সাহস কম।
এই তো একটা সত্যি কথা বললি। হ্যাঁ, তোর সাহস কম–তবে তোর বুদ্ধি আছে। মাথা খুব পরিষ্কার। বোকা বন্ধুর চেয়ে বুদ্ধিমান শত্রু ভালো।
আমি কারো শত্ৰু নাই।
বাজে কথা বলিস না। তুই আমার শত্ৰু, মহা শত্রু।
কেমন করে?
তুই ফিরোজকে সারিয়ে তুলতে চাচ্ছিস। ওকে সরিয়ে তুললে আমি যাব কোথায়? ডাণ্ডাপেটা করব কীভাবে? তুইই বল।
ডাগুপেটা করতেই হবে?।
করব না? বলিস কী তুই! আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, আমি ছেড়ে দেব? পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলব।
লত কী তাতে?
লাভ-লোকসান জানি না। ছোট চৌধুরী লাভ-লোকসানের পরোয়া করে না! তোকে আমি একটা শিক্ষা দেব। এক বাড়ি মেরে টপ করে মাথাটা ফাটিয়ে দেব। গল-গল করে ঘিলু বের হয়ে আসবে। ছিটকে আসবে রক্ত। বড় মজার ব্যাপার হবে। তবে দুই দেখতে পাবি না। আফসোসের কথা।
মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন, এ-বাড়ির প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে। চোখ বড় বড় করে শুনছে। এই অস্বাভাবিক কথোপকথন। কাঁদছেন শুধু ফরিদা।
ফিরোজ হিসহিস করে উঠল, কি, চুপ করে আছিস যে? কথা বলছিস না কেন? ভয় পেয়েছিস? ভয় পেয়ে শেষটায় মেয়েমানুষের আঁচল ধরলি? লজ্জা করে না?
কার কথা বলছ? ওরে হারামির বাচ্চা, তুই জানিস না। কার কথা বলছি? তোর পেয়ারের নীলু বেগম। যার ইয়ে দুটি—। এবং যার ইচ্ছে হচ্ছে—।
কুৎসিত সব কথা। সে একনাগাড়ে বলে যেত লাগল। কদৰ্য অশ্লীলতা। যা ছাপার অক্ষরে লেখার কোনো উপায় নেই। ফিরোজ যে-সব কথা বলতে লাগল, তার ভগ্নাংশও অশ্লীলতম পর্ণো পত্রিকায় থাকে না। ফরিদা দ্রুত ঘরে চলে গেলেন। কাজের লোকগুলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ওসমান সাহেব ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, শাট আপ।
ফিরোজ হাসিমুখে তাকাল ওসমান সাহেবের দিকে যেন খুব মজার কথা বলছে, এমন ভঙ্গিতে বলতে লাগল, আমাকে ইংরেজিতে গাল দিচ্ছে। বাহু, বেশ মজা তো! কাকে তুই ইংরেজিতে গাল দিচ্ছিস? তোর নাড়ি-নক্ষত্র আমি জানি। সালেহা নামের কাজের মেয়েটির সঙ্গে তুই কী করেছিস, বলে দেব? খুব মজা পেয়ে গিয়েছিলি, তাই না? কদিন খুব সুখ করে নিলি! বলব কী করেছিলি? বলব? হা হা হা! কি, পালিয়ে যাচ্ছিস কেন? লজ্জা লাগছে? ফূর্তি করার সময় লজ্জা লাগে নি? একটা ঘটনা বরং বলেই ফেলি–।