সাজ্জাদ হোসেন বললেন, খবর কি তো?
ভালো।
খোঁজ নিতে এলাম টিকে আছিস, না নগ্নগাত্র এসে তোকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিয়ে গেছে।
না, এখনো বানায় নি।
তোর ইমার পাত্তা এখনো লাগাতে পারি নি। পারলেই জানবি।
পারায় সম্ভাবনা কী রকম?
কম। খুবই কম। ঠাণ্ড পানি খাওয়াতে পারবি? খুব ঠাণ্ডা।
ঠাণ্ডা পানি হবে না। ঘরে ফ্ৰীজ নেই।
বাড়িওয়ালার ঘরে নিশ্চয়ই আছে। তোর ইমাকে পাঠিয়ে দে না, নিয়ে আসুক। ঠাও পানি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে!
মিসির আলি ইমাকে পাঠালেন না। নিজেই ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে এলেন। সাজ্জাদ হোসেন টেবিলে পা তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। দেখলেই মায়া লাগে। লোকটির ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, চা খাবি?
না। তোর সোফায় ঘন্টাখানিক শুয়ে থাকব।
সোফায় কেন? বিছানায় শুয়ে থাক।
সোফা হলেই চলবে, বিছানা লাগবে না। তুই কাঁটায়—কাঁটায় এক ঘন্টা পরে ডেকে তুলবি।
ঠিক আছে, তুলব।
সাজ্জাদ হোসেন সোফায় লম্বা হলেন এবং দেখতে- দেখতে ঘুমিয়ে পড়লেন। তবে তাঁকে ডেকে তুলতে হল না। ঠিক এক ঘন্টা পরে নিজেনিজেই জেগে উঠলেন। প্রাণী হিসেবে মানুষের তুলনা নেই। তার অবচেতন মন সর্বক্ষণ কাজ করে। যথাসময়ে তাকে সজাগ করে দেয়। বিপদের আভাস দিতে চেষ্টা করে। মুশকিল হচ্ছে, তার কর্মপদ্ধতি আমাদের জানা নেই। সজ্জাদ হোসেন বললেন, এক কাপ চা খাব। তারপর যাব। আজ সারারাত ডিউটি। যেভাবেই হোক, আজ নগ্নগাত্রকে ধরবই।
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ম্যানিয়াকদের ধরা খুব মুশকিল। এদের ইন্দ্ৰিয় খুব সজাগ থাকে।
সজাগ থাকুক আর যা-ই থাকুক, ব্যাটাকে আজ ধরবই।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দেশ খোদ ইংল্যান্ডেও কিন্তু কিছু-কিছু ম্যানিয়াকদেরকে ধরতে তিন-চার বছর সময় লেগেছে। এক জনের নাম তুই নিশ্চয়ই জানিস—রোডসাইড স্ট্রাংগলার। বেছে বেছে ব্লন্ড মেয়েদের খুন করত। সাড়ে ছ বছর চেষ্টা করেও কিন্তু ওকে ধরা যায় নি।
আমি ধরব। আজ রাতেই ধরব।
মিসির আলি চুপ করে গেলেন। সাজ্জাদ হোসেন বললেন, উঠি?
চা না খাবি বললি?
মত বদলেছি, খাব না।
মিসির আলি বললেন, আমি কি তোর সঙ্গে যেতে পারি?
আমার সঙ্গে যাবি? কেন?
আমি ধানমণ্ডির একটা বাড়িতে ঢুকতে চাই। ওরা ঢুকতে দিচ্ছে না। গেট বন্ধ করে রাখছে এবং বলছে বাড়িতে কেউ নেই। কিন্তু আমি জানি, বাড়িতে লোকজন আছে। পুলিশের গাড়িতে করে গেলে দারোয়ান ভয় পেয়ে গেট খুলবে।
আজ রাতেই যেতে হবে?
হুঁ।
তোকে ঢুকতে দিচ্ছে না কেন?
আছে, অনেক ব্যাপার আছে, পরে বলব। আমাকে ও-বাড়িতে নামিয়ে দিতে তোর অসুবিধা আছে? অসুবিধা থাকলে থাক।
না, অসুবিধা নেই।
রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে।
দারোয়ান জেগেই ছিল। মিসির আলি যা ভেবেছিলেন, তা-ই হল। পুলিশ এসেছে শুনে সে গেট খুলল। মিসির আলি ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
ওসমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন, মিসির আলি গেট দিয়ে ঢুকছেন এবং বেশ সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে আসছেন। ওসমান সাহেব নিচে নেমে এলেন। মিসির আলি বললেন, আপনি ভালো আছেন?
ওসমান সাহেব সে প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
মিসির আলি বললেন, অসময়ে এসেছি। উপায় ছিল না বলেই আসতে হয়েছে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।
ওসমান সাহেবের বসার ঘর
ওসমান সাহেবের বসার ঘর। রাত প্ৰায় এগারটা একটি কম পাওয়ারের টেবিলল্যাম্প ছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই। আবছা অন্ধকার। এই আবছা অন্ধকার ঘরে তিন জন মানুষ মুখোমুখি বসে ছিলেন। এক জন উঠে চলে গেলেন। ফরিদা। তিনি নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। যে আলোচনা চলছিল, তা তাঁর সহ্য না হওয়ায় উঠে গেছেন। এখন বসে। আছেন দু জন–মিসির আলি এবং ওসমান সাহেব। কথাবার্তা এখন বিশেষ হচ্ছে না। ওসমান সাহেবের যা বলার তা বলেছেন। এখন আর তাঁর কিছু বলার নেই। তিনি বসে আছেন মূর্তির মতো। দেখে মনে হচ্ছে, তাঁর মধ্যে জীবনের ক্ষীণতম স্পর্শও নেই। যেন এক জন মরা মানুষ।
মিসির আলি বললেন, আপনি বলছেন, ফিরোজকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন?
হ্যাঁ।
কবে থেকে?
আজ নিয়ে ছ দিন।
এটা তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ এই ছা দিনে বেশ কবার সে বের হয়ে গেছে। পুরানা পল্টন এলাকায় তাকে দেখা গেছে। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে।
ওসমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, কী ভাবে কী হচ্ছে আমি জানি না। আমি যা করেছি, সেটা বললাম। তালা দেয়া আছে। আপনি নিজে গিয়ে দেখতে পারেন।
সেই তালার চাবি কার কাছে? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, অন্য কেউ তালা খুলে দিতে পারে কি না।
না, পারে না। কারণ চাবি আমার কাছে।
অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন তালাবন্ধ করে রাখা সত্ত্বেও সে বের হয়ে পড়ছে?
আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আপনার যা ইচ্ছা মনে করতে পারেন।
মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি কোনো আধিভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। এক জনকে তালাবন্ধ করে রাখা হবে, কিন্তু তবু সে বের হয়ে যাবে–এটা আর যে-ই বিশ্বাস করুক, আমি করব না।
বিশ্বাস করতে আমি আপনাকে বলছি না। আপনি নিজে গিয়ে দেখুন। সেটা না করে আপনি একই কথা বারবার আমাকে বলছেন কেন?
সেটা বলছি, কারণ আমি আগে সমস্ত ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা করতে চাই ওসমান সাহেব, আমি-আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই, আমি এই ছেলেটিকে সুস্থ করে তুলতে চাই। আপনি আমাকে শত্রুপক্ষ মনে করছেন, এটা ঠিক না। আমার কোনো পক্ষ নেই। আমি এক জন চিকিৎসক।