ফিরোজ অবশ্যি উল্টোটা করল। পানি খেল প্ৰথমে। তারপর বেশ সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি আমাকে ভয় পাও কেন হানিফা?
ভয় পাই না তো?
পাও, খুবই ভয় পাও। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এখন সেরে গেছি। পুরোপুরি না-সারলেও অসুখটা আর নেই। চোঁচামেচি হৈচৈ কিছুই করি না। ঠিক না?
জ্বি, ঠিক।
এখন দেখা না–সবাই একা-এক ছেড়ে দেয়। আগে ছাড়ত না।
হানিফা কিছু বলল না।
ফ্যানটা ছেড়ে দাও।
হানিফ ফ্যান ছেড়ে দিল। ফিরোজ ভরি গলায় বলল, এই গরমে সুস্থ মানুষই পাগল হয়ে যায়, আর আমি তো এমনিতেই পাগল।
হানিফার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। বলে কী এই লোক! বাড়িতে আর কেউ নেই। শুনশান নীরবতা। হানিফার ইচ্ছা করতে লাগল, বাড়ির বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।
হানিফা।
জ্বি?
আমাকে ভয় লাগছে?
জ্বি।
ভয়ের কিছু নেই। আমি সেরে গেছি। ঠিক আছে।–তুমি যাও। আমি বসে থাকব। চুপচাপ।
হানিফা রান্নাঘরে চলে গেল। কি মনে করে সে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল! কেন জানি দারুণ ভয় করতে লাগল তার।
ফিরোজ বসে আছে চুপচাপ। তার চোখ ঈষৎ লাল। খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। ছেলেটির বয়স বাইশ, অত্যন্ত সুপুরুষ। চিবুক ਅੰ।। মেয়ে বানাতে গিয়ে মনে করে শেষ মুহূর্তে তাকে পুরুষ বানিয়েছে, এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কিছু কাঠিন্য ঢেলে দিয়েছে।
ফিরোজের সমস্যাটা শুরু হয় এইভাবে—সে দু বছর আগে জানুয়ারি মাসে তার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। যাবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—গ্রাম দেশে। ফিরোজ কখনো গ্রাম দেখেনি।
বন্ধুর বাড়ি ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে। চমৎকার একটা জায়গা। ভোরবেলায় আকাশের গায়ে নীলাভ গারো পাহাড় দেখা যায়। চারদিকে ধু-ধু প্ৰান্তর, বর্ষ আসামাত্র যা পানিতে ডুবে যায়। সেই পানি সমুদ্রের মতো গর্জন করতে থাকে। অল্প বাতাসেই সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ ওঠে।
এখন অবশ্যি শুকনো খটখট করছে। চারদিকে। তবু ফিরোজ মুগ্ধ হয়ে গেল। সবচেয়ে মুগ্ধ হল বন্ধুর বাড়ি দেখে-বিশাল এক দালান। সিনেমাতে পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির মতো বাড়ি। একেকটি ঘর এত উচু এবং এত বিশাল যে, কথা বললেই প্ৰতিধ্বনি হয়।
ফিরোজের বন্ধুর নাম আজমল চৌধুরী। সে তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখাল। অতিথিদের থাকবার জায়গা। নায়ারীদের থাকবার জায়গা। কুয়োতলা। বাড়ির পেছনের সারদেয়াল, যেখানে পূর্বপুরুষদের কবর আছে। ফিরোজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কী কাণ্ড। সে মুগ্ধ কষ্ঠে বলল, এ তো হুলস্থূল ব্যাপার রে আজমল! তোরা রাজা-মহারাজা ছিলি–তা তো কোনোদিন বলিস নি?
এখন কিছুই নেই। দালানটাই আছে, আর কিছুই নেই। সেই দালানই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আরেকটা ভূমিকম্প হলে গোটা দালানই ভেঙে পড়ে যাবে। তা ছাড়া খুব সাপের উপদ্রব।
বলিস কী?
এখন ভয় নেই কোনো সব সাপ হাইবারনেশনে চলে গেছে; গরমের সময় ভয়াবহ কাণ্ড হয়!
কোনো ব্যবস্থা করতে পারিস না?
আজমল কঠিন স্বরে বলল, এর একটামাত্র ব্যবস্থাই আছে, সব ছেড়েছুড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া।
এত চমৎকার ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি, বলিস কী!
চলে যাব। এখানে থাকলে মারা পড়তে হবে। তিনিটামাত্র মানুষ আমরা। আমি, মা আর আমার ছোটবোন। এত বড় বাড়ি দিয়ে আমি করব কী? জঙ্গল হয়ে গেছে চারদিকে, দেখছিস না?
দু দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে ফিরোজ গিয়েছিল, কিন্তু পঞ্চম দিনেও সে ফেরার কথা কিছু বলল না।
বড় আনন্দে সময় কাটতে লাগল। গ্রাম যে এত ইন্টারেষ্টিং হবে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। শুধু একটি খটকা লেগে থাকল। তার মনে। আজমলের বোনের সঙ্গে তার দেখা হল না, যদিও মেয়েটি এই বাড়িতেই থাকে। মেয়েটির নাম-নাজ। আজমলের মা প্রায়ই তাঁর মেয়েকে চিকন গলায় ডাকেন, ও নাজ, ও নাজ। তার উত্তরে মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে সাড়া দেয়। মেয়েটির সাড়াশব্দ এইটুকুই। ফিরোজ এক বার ভেবেছিল, আজমলকে তার বোনের কথা জিজ্ঞেস করে। শেষ পর্যন্ত তা করা হয় নি। প্রাচীনপন্থী একটি পরিবার, হয়তো কিছু মনে করে বসবে। এদের হয়তো কঠিন পর্দার ব্যাপার আছে।
ষষ্ঠ দিন সন্ধ্যায় মেয়েটির সঙ্গে ফিরোজের দেখা হয়ে গেল। ফিরোজ অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলা। চারদিক অন্ধকার। ঘরে স্মালো দিয়ে যায় নি। ফিরোজ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই হকচাকিয়ে গেল! সতের-আঠার বছরের একটি মেয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে একটি হারিকেন। হারিকেনের আলো পড়েছে মেয়েটির মুখে। এই মুখ কি কোনো মানবীর মুখ? অসম্ভব। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত রূপ কি এই মুখে আঁকা নয়? ফিরোজ চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইল—— পারল না। সে তাকিয়েই রইল।
মেয়েটি বলল, আমি নাজনীন।
কিছু-একটা বলতে হয়। ফিরোজ বলতে পারল না। কোনো কথা তার মনে এল না। এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটিকে সে কী বলবে?
ভাইয়া বাজারে গেছে, এসে পড়বে। আপনি বড় ঘরে বসুন–চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফিরোজ বড় ঘরের দিকে রওনা হল। আচ্ছানের মতো, এবং সে মনে করতে পারল না মেয়েটির গায়ে শাড়ি ছিল, না সালোয়ার-কামিজ ছিল। মেয়েটির চুল কি বেণী-বাঁধা ছিল, না খোলা ছিল। তার মুখটি কি গোলাকার, না লম্বাটে। কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে একটি তুলি দিয়ে আঁকা মুখ সে দেখে এসেছে। যে-শিল্পী ছবিটি একৈছেন তাঁর বাস এ পৃথিবীতে নয়।–অন্য কোনো ভুবনে।