হুঁ, তা ঠিক। যাদের লজিক খুব তীক্ষ্ণ, তাদের এটা থাকে না। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের, যাদের লজিক খুব দুর্বল–তাদের থাকে।
স্যার, আমি জানি না। আমি এখন একটি নিম্নশ্রেণীর প্রাণী। কিনা, কিন্তু আমার EPS ক্ষমতা অনেক বেশি। ঠিক এই মুছতে আপনি কী ভাবছেন, আমি বলে দিতে পারি।
নীলু বলতে-বলতে হেসে ফেলল। এবং হাসি ঢাকার জন্যে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। মিসির আলি খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। কারণ, তিনি একটি আপত্তিকর ভাবনা ভাবছিলেন। তিনি ভাবছিলেন–নীলুর সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দুজনেই ভিজে জবজব। হুড় তোলা এবং পর্দা ফেলা। রিকশাওয়ালা বাতাস কাটিয়ে বহু কষ্টে এগুচ্ছে। তিনি নীলুর হাত ধরে আছেন।
স্যার।
কল
শুধু শুধু আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আমরা সবাই তো এ-রকম কত অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা করি, এবং এটাই তো স্বাভাবিক।
হু, তা ঠিক। আমার সঙ্গে কী বলতে চাচ্ছিলে বল। আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ঝড় আসবে।
বলতে না বলতেই বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বাতাস বইতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। নীলু মৃদু স্বরে বলল, রানু আপাকে তো আপনি ভালো মতন চিনতেন, তাই না। স্যার?
হ্যাঁ।
রানু আপার সঙ্গে আমার কী কী মিল আছে?
কোনো মিল নেই। প্রতিটি মানুষই আলাদা। এক জন মানুষের সঙ্গে অন্য এক জন মানুষের মিল থাকে সামান্যই।
আপার অসম্ভব ইএসপি ক্ষমতা ছিল। ছিল না?
তা ছিল।
আমারও আছে। আছে না?
হ্যাঁ, আছে।
রানু আপা কি আপনাকে কখনো বলেছিল, তার ভেতরে এক জন দেবী বাস করেন?
বলেছিল।
আপনি বিশ্বাস করেন নি?
না, করি নি। এইসব ছেলেমানুষ জিনিস বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
স্যার, রানু আপা যা বলত, এখন আমি যদি তা-ই বলি–আপনি বিশ্বাস করবেন।
না।
পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে স্যার।
একসময় ঝড়-বৃষ্টিকেও রহস্যময় মনে করা হত, এখন করা হয় না। মানুষের জ্ঞান, মানুষের বুদ্ধি রহস্যময়তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে যত অলৌকিক ব্যাপার আছে, তার প্রতিটির পেছনে আছে একটি লৌকিক ব্যাখ্যা।
মিসির আলি সিগারেট ধরলেন এবং বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন– দেখ নীলু, তুমি বলছ, তোমার ভেতর একজন দেবী আছেন। সেই দেবী যদি এই তোমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন এবং আমাকে বলেন এই যে মিসির সাহেব। তাহলেও আমি ব্যাপারটা বিশ্বাস করব না। আমি খুঁজব একটা লৌকিক ব্যাখ্যা।
কী হবে সেই ব্যাখ্যা?
আমি যা দেখব, মনোবিজ্ঞানীর ভাষায় তার নাম হেলুসিনেশন। কিছু-কিছু ড্রাগস আছে, যা খেলে হেলুসিনেশন হয়। যেমন এলএসডি। ইংল্যাণ্ডে আমি এক ছাত্রকে দেখেছিলাম–সে এলএসডি খেত যিশুখ্রিষ্টকে দেখার জন্যে। এলএসডি খেলেই সে যিশুখ্রিষ্টকে দেখতে পেত। তুমি বুঝতেই পারছি, সে যা দেখত, তা হেলুসিনেশন।
নীলু দীর্ঘ সময় চুপ কুরে বসে রইল। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। এক-একটা বাতাসের ঝাপটা এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে, তবু দুজনের কেউ নড়ল না। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু মিসির আলির সিগারেটের আলো ওঠানামা করছে।
নীলু ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার।
বল।
আমি একটি খারাপ লোকের হাতে পড়েছিলাম স্যার। একটা ভয়ঙ্কর খারাপ লোক আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নির্জন একটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সে একটা ক্ষুর নিয়ে এসেছিল আমাকে মারতে। তখন সেই দেবী আমাকে রক্ষা করেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমার দেখা। দেবীকেও আমি দেখেছি। একটি অপূর্ব নারীমূর্তি।
তুমি বলতে চাও, তারপর থেকে সেই দেবী তোমার সঙ্গে আছে?
হ্যাঁ।
তুমি যা দেখেছ, তার যে একটা লৌকিক ব্যাখ্যা হতে পারে–তা কি তুমি ভেবেছ?
সবকিছুর ব্যাখ্যা নেই স্যার।
চেষ্টা করে দেখি, এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় কিনা।
ঠিক আছে, চেষ্টা করুন।
রানু মেয়েটির সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল। তার কাছ থেকেই দেবীর ব্যাপারটি তুমি শুনেছ।। একটা নতুন ধরনের কথা। রোমান্টিক ফ্লেভার আছে দেবীর ব্যাপারটায়, কাজেই জিনিসটা তোমার মনে গেঁথে রইল। তুমি নিজে যখন বিপদে পড়লে, ঐ জিনিসটাই উঠে এল তোমার মনের ভেতর থেকে। একটা হেলুসিনেশন হল। তীব্র মানসিক চাপ এবং তীব্ৰ হতাশা থেকে এই হেলুসিনেশনের জন্ম। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে strees induced hallicination.
ঐ খারাপ লোকটি মারা গেল কীভাবে?
তাঁর মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক কারণে। পা পিছলে উন্টে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে বা এইজাতীয় কিছু। এখানে দেবীর কোনো ভূমিকা নেই, লোকটির সুরতহাল রিপোর্ট থেকেই তার মৃত্যুর কারণ বের হয়ে আসা উচিত। কী ছিল পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে?
মিসির আলি প্রশ্নের জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন। কোনো জবাব পাওয়া গেল। না। নীলু মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। অন্ধকারে পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কেন জানি তাঁর মনে হল, মেয়েটি কাঁদছে। কাঁদবে কেন সে? কাঁদার মতো কোনো কথা কি তিনি বলেছেন?
নিলু?
জ্বি।
আমি এখন উঠি? আমার যাওয়া দরকার। এ-বৃষ্টি কমবে না। যত রাত হবে, তত বাড়বে। তুমি কি আমাকে আরো কিছু বলবে?
নীলু জবাব দিল না। মিসির উঠে দাঁড়ালেন।
তোমার বাবাকে খবর দাও, বিদেয় নিয়ে যাই।
নীলু কঠিন কণ্ঠে বলল, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
তিনি বিঘিত হয়ে বললেন, বাসায় যাচ্ছি, আর কোথায় যাব?