মিসির আলি বললেন, আপনার আরেকটি মেয়ে ছিল। ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
কোথায় আছে সে?
বাইরে।
বিলুর প্রসঙ্গ উঠলেই জাহিদ সাহেব অনেক কথা বলেন। কিন্তু আজ এই লোকটির সঙ্গে কোনো কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
মিসির আলি সাহেব।
জ্বি?
আমার মাথা ধরেছে, আমি একটু শুয়ে থাকব। কিছু মনে করবেন না। আমি নীলুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
জ্বি আচ্ছা।
জাহিদ সাহেব নীলুর ঘরে উঁকি দিয়ে অবাক এবং দুঃখিত হলেন। নীলুশাড়ি বদল করেছে। সাধারণ শাড়ি বদলে বেগুনি রঙের চমৎকার একটি শাড়ি পরেছে এবং চুল বাঁধছে। এর মানেটা কী?
নীলু।
জ্বি।
তোর স্যার বসে আছেন নিচে।
যাচ্ছি বাবা।
বেশিক্ষণ ওঁকে আটকে রাখা ঠিক না। আকাশের অবস্থা খারাপ।
বাবা, আমি তো ওকে আজ রাতে এখানে থেকে যেতে বলব।
সে কী কেন?
আমার কথা শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যাবে। এত রাতে আমি ওঁকে ছাড়ব না।
কথাটা তাহলে দিনের বেলা বল। কাল ওকে আসতে বলে দে।
বাবা, ওঁর সঙ্গে আজই আমার কথা বলা দরকার। একটা রাত উনি এখানে থাকলে, তোমার কি কোন আপত্তি আছে?
জাহিদ সাহেব হ্যাঁ, না।–কিছুই বলতে পারলেন না। নীলু বলল, আমাদের গেষ্টরুমটা ঠিকঠাক করে রেখেছি। উনি সেখানেই থাকবেন! তুমি এত গম্ভীর হয়ে আছ কেন বাবা? আপত্তি থাকলে বল—আমার আপত্তি আছে।
আমার আপত্তি আছে।
আপত্তিটা কেন?
ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে তোর এত কিসের খাতির?
খাতির কিছু নেই বাবা। উনি আমার টীচার এবং চমৎকার এক জন টীচার! আমি অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর প্রতি আমার অন্য রকম একটা শ্রদ্ধা আছে।
এই জন্যেই কি এত শাড়ি-গয়না পরে সাজতে শুরু করেছিস?
না বাবা, সে জন্যে সাজছি না এবং তুমি যা ভাবিছ তাও ঠিক না। আমি এত সাজগোজ করছি, কারণ স্যার রিকশা করে আসতে আসতে ভাবছিলেন, আমাকে দেখবেন বেগুনি রঙের একটা শাড়িপরা অবস্থায়। কাজেই আমি এইভাবে সেজেছি। রহস্যময় সবকিছুতে স্যারের অবিশ্বাস আছে, আমি সেটা দূর করতে চাই। চলে যেওনা বাবা, আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। এই স্যার রানু আপার ব্যাপারটা খুব ভালো জানেন। রানু আপার রহস্যের সঙ্গে আমার রহস্যের একটা মিল আছে। সেই মিল নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমি কথা বলব।
নীলুদম নেয়ার জন্যে থামলা জাহিদ সাহেব কী বলবেন, তেবে পেলেন না।
বাবা।
বল।
স্যার যদি আজ রাতে এ বাড়ির গেষ্টরুমে থাকেন, তোমার কি খুব বেশি আপত্তি হবে?
না।
আমি যখন স্যারের সঙ্গে কথা বলব, তখন তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে থাকতে পার।
না, আমি শুয়ে থাকব, আমার মাথা ধরেছে।
না বাবা, তোমার মাথা ধরেনি। তুমি আমার স্যারকে খুবই অপছন্দ করছ বলে এ— রকম করছ। বাবা, তোমাকে শুধু একটা কথা বলি-মানুষ হিসেবে উনি প্রথম শ্ৰেণীর। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না?
বিশ্বাস করব না কেন? করছি।
না, তুমি করছ না। তাতে অবশ্যি কিছু যায়-আসে না, তবে তুমি যদি বিশ্বাস করতে, তাহলে আমার ভালো লাগত। ঠিক আছে বাবা, তুমি যাও, শুয়ে থাক। রাত দশটার সময় টেবিলে ভাত দেব, তখন তোমাকে ডাকব।
নীলু বসার ঘরে ঢুকল নিঃশব্দে। মিসির আলি চাঁপা ফুলের হালকা একটা সুবাস পেয়ে চমকে পেছনে ফিরলেন। নীলু বলল, কেমন আছেন স্যার?
তিনি কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তাঁর দারুণ অস্কাপ্তি ও লজ্জা লাগতে লাগল।
একটা বিব্রতকর অবস্থা। কারণ তিনি রিকশায় আসতে-আসতে নীলুকে যেভাবে দেখবেন কল্পনা করেছিলেন, সে ঠিক সেভাবেই সেজেছে। কাকতালীয় মিল বলে একে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। দুটি কারণে এ রকম হতে পারে। হয়তো নীলু। এ-রকম সেজে বসে ছিল। তিনি তাঁরই এস পি-র মাধ্যমে তা টের পেয়েছেন। এটা সম্ভব নয়, কারণ মিসির আলি খুব ভালো করেই জানেন, তাঁর কোনো ESP. ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় কারণটি যদি সত্যি হয়, তাহলে বড় অস্বস্তির ব্যাপার হবে। তিনি রিকশায় আসতে—আসতে যা ভাবছিলেন, নীলু তা টের পেয়েছে এবং সেইভাবে সেজেছে। এ রকম হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
মিসির আলি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁর মনে নীলু সম্পর্কে যেসব কল্পনা আছে, তা তিনি আড়াল করে রাখতে চান। বিশেষ করে টেনে আসতেআসতে যে স্বপ্নটা দেখেছেন। এটি যদি নীলুটের পায়, তাহলে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, দেখ নীলু, স্বপ্নের ওপর আমার হাত নেই। স্বপ্ন হচ্ছে স্বপ্ন।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানের এক জন শিক্ষক হিসেবে তিনি জানেন, স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। অবচেতন কামনা-বাসনার ছবি। তিনি তাকালেন নীলুর দিকে। মেয়েটির মুখে হাসি। ছোটদের দুষ্টুমি দেখে বড়রা যে-রকম হাসে, সে-রকম।
নীলু বলল, স্যার চলুন, আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি।
আমি বেশিক্ষণ বসব না নীলু। আকাশের অবস্থা ভালো না, ঝড় হবে।
হলে হবে। ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে ঠিক এই আপনাকে ভাবতে হবে না।
বারান্দায় অন্ধকার। সেখানে পাশাপাশি দুটি বেতের চেয়ার দেয়া আছে। গ্রিল থাকা সত্ত্বেও বারান্দায় বসে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়, যে—আকাশে অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী বলবে তুমি, বল।
নীলু বলল, আপনি একবার ক্লাসে ESP-র ওপর বলেছিলেন। আপনার মনে আছে?
আছে।
আমার এবং আমার কয়েকজন বন্ধুর ESP আছে কি না তা পরীক্ষা করলেন। মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে। জেনার কার্ড দিয়ে পরীক্ষা।
সেই পরীক্ষায় আমরা কেউ পাস করতে পারি নি। তার মানে, আমাদের কারোরই এক্সটা সেনাসরি পারসেপশান ক্ষমতা নেই।