কথাটা বলেই সাজ্জাদ হোসেনের মনে হল, একটা বড় ভুল হয়ে গেল। আই জি এমন কোনো ব্যক্তি নন, যিনি রসিকতা সহজভাবে নেবেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড, মতিয়ুর রহমান সাহেব হেসে ফেললেন। মুচকি হাসি নয়। হা হা করে হাসি।
সাজ্জাদ হোসেনের জীবনে এটা একটা স্মরণীয় দিন। তাঁর মনের গ্রানি কেটে যেতে শুরু করেছে। তিনি অফিসে ফিরে দুটি সংবাদ শুনলেন–দশ মিনিট পরপর কে নাকি তাঁকে খোঁজ করছে এবং গত রাতে নগ্নগাত্ৰ ত্ৰাস একটি ছ বছরের ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তার ডেডবডি কিছুক্ষণ আগেই রিকভার করা হয়েছে। চেনার উপায় নেই। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে থেতলে ফেলা হয়েছে। সাজ্জাদ হোসেন তক্ষুণি জীপ নিয়ে বেরুলেন।
হ্যালো, এটা কি ফিরোজদের বাসা?
হ্যাঁ।
আপনি কে কথা বলছেন?
আপনি কে এবং আপনার কাকে দরকার, সেটা বলুন।
আমার নাম মিসির আলি।
ও আচ্ছা। আমি ফিরোজের মা।
স্লামালিকুম আপা।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আমি সপ্তাহখানেক বাইরে ছিলাম। আপনাদের খবর দিয়ে যেতে পারি নি।
ও।
গিয়েছিলাম চব্বিশ ঘন্টার জন্যে, ঝামেলায় পড়ে এত দেরি হল। আমি ব্যাপারেই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।
ও।
ফিরোজ কেমন আছে?
ভালো।
ওকে টেলিফোনটা দিন।
ওকে টেলিফোন দেয়া যাবে না।
বাসায় নেই।
না।
কোথায় গিয়েছে? বাইরে?
হ্যাঁ।
তাহলে আমি বরং রাতের বেলা এক বার টেলিফোন করব।
না, রাতের বেলা টেলিফোন করবেন না। ওকে পাওয়া যাবে না।
কেন, ও কি রাতে ফিরবে না?
না ও ঢাকার বাইরে।
ঢাকার বাইরে—কোথায়?
ওর মামার বাড়িতে,–বরিশালে।
কিন্তু আমি তো বলেছিলাম ওকে দীর্ঘদিন চোখে-চোখে রাখতে হবে।
কোনো উত্তর নেই।
হ্যালো।
বলুন।
কী হয়েছে ফিরোজের?
কী আবার হবে? কিছুই হয় নি। ও ভালো আছে।
কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, কিছু-একটা হয়েছে। আপনি কি দয়া করে বলবেন?
ওর কিছু হয় নি। ও ভালো আছে। ও আছে তার মামার বাড়িতে।
বরিশালে?
হ্যাঁ, বরিশালে।
আপনি ঠিক কথা বলছেন না। কারণ ফিরোজের মামার বাড়ি বরিশাল নয়। ফিরোজ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমার জানা। দয়া করে আপনি আমাকে বলুন, কী হয়েছে।
কিছু হয় নি। অনেকবার তো এই কথা বললাম। তবু কেন বিরক্ত করছেন?
ওসমান সাহেবকে দিন। তাঁর সঙ্গে কথা বলব।
উনি বাসায় নেই।
কখন ফিরবেন
জানি না। কখন ফিরবেন।
শুনুন আপা, আমি আসছি এই মুহূর্তে।
মিসির আলি টেলিফোন নামিয়ে রেখে তক্ষুণি ধানমণ্ডি ছুটলেন। কিন্তু ওসমান সাহেবের বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারলেন না। দারোয়ান গোট বন্ধ করে বসে আছে। সে কিছুতেই গেট খুলবে না। ওসমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী-কেউ নাকি বাড়ি নেই। কখন ফিরবেন তারও ঠিক নেই। মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে, আমি বসার ঘরে অপেক্ষা করব। গেট খোল।
সাহেব। আর মেমসাহেব বাড়িতে না থাকলে গেট খোলা নিষেধ আছে।
মিসির আলি প্ৰায় দু ঘন্টা বন্ধ গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো লাভ হল না। নীলুদের বাসা কাছেই কোথাও হবে। ঝিকাতলা ধানমণ্ডি থেকে খুব-একটা দূর নয়। মিসির আলি সেদিকেই রওনা হলেন।
ফিরোজের কথা বারবার মনে আসছে। কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছেন না। কী হল ছেলেটার? আর যদি কিছু হয়েই থাকে, সবাই মিলে এটা তার কাছে গোপন করছে কেন? রহস্যটা কী? রাতে ফেরবার পথে আরেক বার খোঁজ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক
মিসির আলি নরম স্বরে বললেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক। আমার এক ছাত্রী কি এ বাড়িতে–।
বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, আসুন, আমি নীলুর বাবা। আমার নাম জাহিদুল ইসলাম।
স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। বসুন আপনি, নীলু এসে পড়বে।
ওকে খবর দিন। আর বেশিক্ষণ থাকব না, আকাশের অবস্থা ভালো না—ঝড়-বৃষ্টি হবে।
জাহিদ সাহেব তাঁর মেয়েকে খবর দেয়ার জন্যে মোটেই ব্যস্ত হলেন না। খবর দেয়ার কিছু নেই। নীলু খবর পেয়ে গেছে। দশ মিনিট আগেই সে বলেছে, স্যার আমাদের বাসার দিকে রওনা হয়েছেন। এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যে।
নীলুর মুখ উজ্জ্বল এবং হাসি-হাসি। এইসব জাহিদ সাহেবের ভালো লাগছে না। এক জন মাঝবয়সী অধ্যাপকের জন্যে এত আগ্রহ নিয়ে তাঁর মেয়ে অপেক্ষা করবে কেন?
তিনি একটি সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়েকে নিজের পাশে চান–যার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। কী হবে না হবে, যা সে আগে থেকে বলতে পারবে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে যে গ্ৰহণ করবে। আর দশটি মেয়ের মতো।
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার এ-বাড়িতে আগে এক বার এসেছি। আনিস সাহেব বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর স্ত্রীকে কিছুদিন চিকিৎসা করেছিলাম।
আমি জানি।
আনিস সাহেব কি এখনো এ-বাড়িতে থাকেন?
না।
অন্য কোনো ভাড়াটে এসেছে বুঝি?
না, বাড়ি ভাড়া দিই না এখন, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
এ কথা বলছেন কেন?
রানু মেয়েটা এ-বাড়িতে না থাকলে, আজ আমার মেয়ের এ-অবস্থা হত না।
এত জোর দিয়ে তা বলা কি ঠিক? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউ তো জানি না।
জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। রোগা, কালো এবং কিঞ্চিৎ কুজো হয়ে বসে থাকা এই লোকটিকে তাঁর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। নীলু। এই লোকটির মধ্যে কী দেখেছে? জাহিদ সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে উঠে চলে যেতে। কিন্তু বাইরের একটি লোককে একা বসিয়ে রেখে উঠে চলে যাওয়া যায় না। তিনি লক্ষ করলেন, ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন। তাঁর সামনেই অ্যাশটে। তবু তিনি চারদিকে ছাই ফেলছেন। কী কুৎসিত স্বভাব। এরা ছাত্রদের কী শেখাবে? নিজেরাই তো কিছু শেখে নি।