তিন জন পুলিশের একটি দল আসছে গল্প করতে করতে। সাজ্জাদ হোসেন লক্ষ করলেন, এদের সঙ্গে টর্চলাইট নেই। অথচ বলে দেয়া হয়েছিল, পাঁচ-ব্যাটারির একটি টাৰ্চলাইট যেন সঙ্গে থাকে। পুলিশ বাহিনীতে একটি কাজও কি কখনো ঠিকমতো করা হবে না।
হল্ট।
তিন জন দাঁড়িয়ে পড়ল এবং স্যালুট দিল।
তোমরা তিন জন কেন? একেকটা দলে দু জন করে থাকতে বলেছি। তৃতীয় জন এসে জুটল কীভাবে?
জানা গেল, এই ব্যবস্থা তারা নিজেরা করে নিয়েছে। তিন জন থাকলে নাকি মনে বেশি সাহস থাকে।
তোমরা কি লোহার রড হাতে একটা লোকের তয়ে আধমরা হয়ে গেছ? এক জন আনসারের সাহসও তো তোমাদের চেয়ে বেশি।
ওরা কিছু বলল না। তিনি থমথমে গলায় বললেন, মেইন রোড ধরে হাঁটছ কেন? আমি বলেছি না, অলি-গলিতে থাকবে এবং কিছুক্ষণ পরপর বাঁশি বাজাবে? আমি পনের মিনিট এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, একবারও তো তোমাদের বাঁশি শুনলাম না।
বাঁশি শুনলে তো স্যার ঐ ব্যাটা সাবধান হয়ে যাবে। ধরতে পারব না।
ঐ ব্যাটার জন্যে আমার মোটেও মাথাব্যথা নেই। বাঁশি বাজানো দরকার অন্যদের সাহস দেবার জন্যে। যাতে সবাই বুঝতে পারে, ভালো পুলিশ-পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। বুঝতে পারছ?
জ্বি স্যার।
আর শোন, রাত একটার পর যাকেই দেখবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। খালিগায়েই হোক কিংবা কোট-প্যান্ট পরাই হোক। বুঝতে পারছ?
জ্বি স্যার!
সাজ্জাদ হোসেন গোরস্থানে ঢুকলেন। সন্দেহজনক কিছুই কোথাও নেই। টুপিপরা দু-তিন জন লোক ঘোরাফেরা করছে। এরা গোরস্থানেরই লোক। তবু তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ওদের একজন হাসি মুখে বলল, গোরস্থানে কোনো আজেবাজে লোক ঢোকে না স্যার। গোরস্থান হইল গিয়া আল্লাহ্ পাকের খাস জায়গা।
সাজ্জাদ হোসেন প্রচণ্ড ধমক দিয়ে তাকে থামালেন। তাঁর আঠার বছরের পুলিশী জীবনে তিনি ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের গোরস্থান এবং মসজিদে লুকিয়ে থাকতে দেখেছেন।
তোমরা সজাগ থাকবে এবং লক্ষ রাখবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
কাল থেকে গোরস্থানের ভেতরেও আমি পুলিশ বসাব।
জি আচ্ছা স্যার।
যত শুয়োরের বাচ্চা।
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পুলিশ সাহেব গালটা কাকে দিলেন, বোঝা গেল না। এই লোকের মেজাজ খারাপ গোরস্থানের ভেতর কেউ এ-রকম গরম দেখায় না। এত সাহস করো নেই।
সাজ্জাদ হোসেন তাঁর জীপ নিয়ে আরো খানিকক্ষণ এই অঞ্চলে ঘুরলেন। একটা পাগল-ছাগল রড হাতে বের হয়েছে এবং সেই কারণে এ-জাতীয় পুলিশী তৎপরতার কোনো মানে হয় না। কিন্তু এটা করতে হয়েছে, কারণ এক জন মন্ত্রর শ্বশুরবাড়ি এই অঞ্চলে। এমনিতেই মন্ত্রীদের যন্ত্রণায় প্ৰাণ বের হয়ে যায়, তার ওপর ইনি হচ্ছেন নন। পালামেন্টারিয়ান মন্ত্রী। এদের গরমই আলাদা।
তিনি মন্ত্রীসাহেবের শ্বশুরবাড়ির সামনে জীপ থামালেন। বাড়ির সামনেই পুলিশ পাহারা আছে। সব ক জন মন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ির সামনে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হলে তো সর্বনাশ। বিশাল এক পুলিশবাহিনী লাগবে মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনদের জন্যে।
সাজ্জাদ হোসেনের মুখ তেতো হয়ে গেল। তিনি শব্দ করে থুথু ফেললেন। মিসির আলির বাড়িও এ-অঞ্চলে। ঠিকানা সঙ্গে নেই। ঠিকানা থাকলে একবার যাওয়া যেত। মিসির আলির কাজের মেয়েটি সম্পর্কেও তিনি কিছু খোঁজখবর নিয়েছেন। হারিয়ে— যাওয়া বেশকিছু মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো দিয়ে মিসির আলিকে আপাতত ঠাণ্ডা করা যাবে।
সেন্ট্রি এগিয়ে আসছে।
সাজ্জাদ হোসেন বললেন, কী খবর?
খবর স্যার ভালো।
সব ঠিকঠাক?
জ্বি স্যার। তবে স্যার, এই বাড়ির লোকজন আমার সাথে খুব রাগারাগি করছে।
কেন?
এরা নাকি দু জন সেন্ট্রি চেয়েছিল। এক জন দেখে রেগে গেছে।
দু জল লাগবে কেন? এরা কোন দেশের মহারাজ?
স্যার, কী বললেন? কিছু বলি নি।
যাও, ডিউটি দাও।
এরা স্যার জিজ্ঞেস করছিল, তোমাদের ডিউটি অফিসার কে।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার। বলছিল, ব্যাটার চাকরি খাব।
সাজ্জাদ হোসেন আবার থুথু ফেললেন। মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনেরা কথায় কথায় চাকরি খেতে চায়। চাকরি ছাড়া ওদের মুখে অন্য কিছু রোছে না। শালা!
সেন্ট্রি।
জ্বি স্যার?
যাও, ডিউটি করা দেখি, আমি আরেক জনকে পাঠাব।
সাজ্জাদ হোসেন মনে মনে ভাবলেন, পুলিশের চাকরি করার মানেই হচ্ছে পদেপদে অপমানিত ও অপদস্থ হওয়া।
মিসির আলি ঢাকা পৌঁছলেন
মিসির আলি ঢাকা পৌঁছলেন। রবিবার ভোরে। দরজা নীলুর চিঠিভর্তি খাম পেলেন। চিঠিতে একটিমাত্র লাইন–স্যার, আপনার বড় বিপদ কিসের বিপদ–কী সমাচার, কিছুই লেখা নেই।
মেয়েদের নিয়ে এই সমস্যা। তাদের সব চিঠিতেই অপ্রয়োজনীয় কথার ছড়াছড়ি। শুধু প্ৰয়োজনীয় কথাগুলোর বেলায় তারা শর্টহ্যাণ্ড ভাষা ব্যবহার করে। আজ পর্যন্ত মেয়েদের এমন কোনো চিঠি পান নি, যেখানে জরুরি কথাগুলো গুছিয়ে লেখা।
তবে নীলু একটি কাজ করেছে। নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে। এক্ষুণি চলে যাওয়া যায়। মিসির আলি গেলেন না। হাত-মুখ ধুয়ে প্ল্যান করতে বসলেন, আজ সারাদিনে কী কী করবেন।
(ক) হানিফার খোঁজ নেবেন।
(খ) ইউনিভার্সিটিতে যাবেন।
(গ) ফিরোজের খোঁজ নেবেন।
(ঘ) সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করবেন।
(ঙ) আজমলের সঙ্গে দেখা করবেন।
এই পাঁচটি কাজ শেষ করবার পর নীলুর কাছে যাওয়া যেতে পারে। তাঁর এমন কোনো বিপদ নেই যে, এক্ষুণি ছুটে যেতে হবে। তবে কেন জানি নীলুর কাছে আগে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে ফ্লয়েডীয়ান কোনো ব্যাখ্যা এর নিশ্চয়ই আছে।