বাসায় আমার কিছু ঝামেলা আছে।
তাহলে স্যার, আপনি কি আমাদের বাসায় একটু আসবেন? আমার খুব দরকার।
ঠিক আছে, যাব।
আমাদের বাসার ঠিকানা কি আপনার মনে আছে? এক বার গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়! আমাদের বাসার দোতলায় আপনার এক জন পরিচিত মহিলা থাকতেন। রানু में!
আমার মনে আছে।
স্যার, আপনি কি আজই আসবেন? আমার খুব দরকার।
মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। এই মেয়ের নাম নীলু, কিন্তু কোনোএক বিচিত্র কারণে তাকে অবিকল রানুর মতো দেখাচ্ছে।
স্যার, আপনি কি আজই যাবেন?
ঠিক আছে রানু।
আমার নাম কিন্তু স্যার নীলু।
মিসির আলি লক্ষ করলেন, মেয়েটা হাসছে। যেন তাকে রানুবলায় সে খুশি। এটাই যেন আশা করছিল।
আমাদের বাসার ঠিকানা কি লিখে দেব?
লিখে দিতে হবে না। আমার মনে আছে।
আসবেন কিন্তু স্যার।
আসব। আমি আসব।
যাই স্যার, স্নামালিকুম।
নীলু উঠে দাঁড়াল। এত সুন্দর মেয়াটা শ্যামলা গায়ের রঙ। চোখে-মুখে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু তবু এমন মায়া জাগিয়ে তুলছে কেন? মিসির আলি লজ্জিত বোধ করলেন। তাঁর বয়স একচল্লিশ। এই বয়সের এক জন মানুষের মনে এজাতীয় তরল ভাব থাকা উচিত নয়। তা ছাড়া এই মেয়েটি তাঁর ছাত্রী।
মিসির আলি শূন্য ক্লাসে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। একসঙ্গে বেশ কয়েকটা জিনিস নিয়ে তিনি ভাবছেন। মেয়েটির মাথায় ঘোমটা কেন? এই মেয়েটি দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাসে আসছে না কেন? মেয়েটি চলে যাবার সময়ও একটা অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। সোজাসুজি হেঁটে গেছে, এক বারও পেছনে ফিরে তাকায় নি। মেয়েরা সাধারণত পেছন ফিরে তাকায়।
সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপারটি হচ্ছে, একটি মৃতা মেয়ের ছাপ আছে নীলুর মধ্যে। যেভাবেই হোক আছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না।
তিনি সিগারেট ধরালেন।
প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না।–কথাটা কি সত্যি? তাঁর মনে হল, সত্যি নয়। কাজই হচ্ছে নানান রকম রহস্য সৃষ্টি করা-মানুষের কাজ হচ্ছে সেই রহস্যের কুয়াশা সরিয়ে দেয়। এমন একদিন কি আসবে, যখন কেউ বলবে না।– দেয়ার আর মেনি থিংকস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ …।
আরে, মিসির আলি সাহেব না? এখানে কী করছেন? এক-একা ক্লাসে বসে আছেন কেন?
তিনি দাড়িওয়ালা এই লোকটাকে চিনতে পারলেন না; হাতে রেজিষ্টি খাতা, কাজেই অধ্যাপক হবেন। মুখখানা হাসি-হাসি। পান খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলেছেন। পান-খাওয়া লোকজন কি কিছুটা নম্ন স্বভাবের হয়? মিসির আলির মনে হল, পান এবং স্বভাবের ভেতর কোনো- একটা সম্পর্ক আছে। তিনি যে ক জন পানবিলাসী লোককে চেনেন, তাদের সবাই সদালাপী।
কি, কথা বলছেন না কেন? কিছু ভাবছেন নাকি?
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত ও নরম স্বরে বললেন, জ্বি-না, কিছু ভাবছি না।
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
জ্বি-না।
দাড়িওয়ালা অধ্যাপক অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। মিসির আলি বিব্রত বোধ করলেন। কাউকে চিনতে পারছি না বলা।–তাকে প্রায় অপমান করার শামিল। বিশেষ করে অধ্যাপক শ্রেণীর মানুষরা এ ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর।
সত্যি চিনতে পারছেন না?
জ্বি না। আমার একটা প্রবলেম আছে, কিছুই মনে থাকে না।
মাসখানেক আগে আমি আপনার কাছে এক জন রোগী নিয়ে গিয়েছিলাম–ফিরোজ নাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র।
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনি ফিরোজের দুলাভাই।
হ্যাঁ দুলাভাই।
এবং আপনার নাম হচ্ছে নাজিমুদ্দিন। হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট।
এই তো চিনতে পারছেন।
চিনতে পারছি এসোসিয়েশন থেকে একটা মনে পড়লে, অন্যগুলো মনে পড়তে থাকে। এসোসিয়েশন অব আইডিয়াস।
ফিরোজ তো অনেকখানি ইমপ্রুভ করেছে। এত অল্প সময়ে যে আপনি এতটা করবেন, আমরা কেউ কল্পনাও করি নি। দারুণ ব্যাপার!
মিসির আলি কিছু বললেন না। ফিরোজ আজ বিকেলে তাঁর কাছে আসবে। প্রতি সোমবার ফিরোজের সঙ্গে তাঁর একটি সেশন হয়। অথচ নীলুকে বলে রেখেছেন, আজ যাবেন তাদের বাসায়। তাঁর কাজকর্ম ইদানীং এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? বয়স বাড়ছে।
মিসির আলি সাহেব!
জ্বি।
চলুন, লাউঞ্জে বসে চা খাওয়া যাক।
চলুন।
আপনি এত গম্ভীর হয়ে আছেন কেন? কী ভাবছেন এত?
কিছু ভাবছি না। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘনিঃশ্বাসটি কেন ফেললেন, এই নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন। অকারণে তো কেউ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে না। সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে। এই জগতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না, সবই লজিক। জটিল লজিক জটিল কিন্তু অভ্রান্ত। লজিকের বাইরে এক চুলও কারোর যাবার ক্ষমতা নেই।
ফিরোজ মিসির আলির কাছে আসে
গত দু মাস ধরে ফিরোজ প্রতি সোমবারে মিসির আলির কাছে আসে। পাঁচটার সময় আসে, থাকে সাতটা পর্যন্ত। আজ কী মনে করে তিনটার সময় চলে এসেছে। মিসির আলি তখনো ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরেন নি। তাঁর কাজের মেয়ে হানিফা দরজা খুলে দিল। সে দরজা খুলল ভয়ে-ভয়ে। ফিরোজের দিকে তাকালেই তার বুক টিপটপ করে। বড় ভয় লাগে।
স্যার কি আছেন, হানিফা?
জ্বি-না।
আজ একটু সকাল—সকাল এসে পড়েছি। আমি বসি, কেমন?
জ্বি আইচ্ছা।
তুমি আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত খাওয়াতে পার? প্রচণ্ড গরম।
হানিফার বয়স দশ। কিন্তু সে খুবই চটপটে। মিসির আলি সাহেব তাকে অল্পদিনের মধ্যেই বর্ণপরিচয় করিয়েছেন। পড়াশোনার ব্যাপারে তার অসম্ভব আগ্ৰহ। মেয়েটি এমনিতেও চটপটে। সে বড় এক গ্লাস শরবত বানাল। তিন টুকরা বরফ ছেড়ে দিল। টেতে করে শরবতের গ্লাস এবং আরেক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে গেল। সে দেখেছে শরবত খাবার পরপরই সবাই পানি খেতে চায়।