হ্যাঁ, নিশ্চিত।
মিসির আলি আবার তাকালেন ছবির দিকে। তাঁর কেন জানি মনে হল, ছবির মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিদ্রুপের হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি।
পুরানা পল্টনে আতঙ্ক
নীলু পত্রিকার খবরটা চারবার পড়ল।
একটা লাল কলম দিয়ে বক্স করা খবরটির প্রতিটি লাইন দাগাল, তারপর কাগজটা তার বাবাকে দিয়ে এল। খবরটা এ-রকম—
পুরানা পল্টনে আতঙ্ক
(স্টাফ রিপোর্টার)
শুক্রবার রাত একটার দিকে পুরানা পল্টন এলাকায় মধ্যযুগীয় নাটকের অবতারণা হয়েছে। লোহার রড হাতে এক যুবক অত্র অঞ্চলে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অনুযায়ী উক্ত যুবকটির পরনে ছিল কালো প্যান্ট। গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। সে প্রথমে একটা রাস্তার কুকুর পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং তার পরপরই গাড়ি বারান্দায় শুয়ে থাকা কিছু ছিন্নমূল মানুষকে আক্রমণ করে। সৌভাগ্যবশত কেউ হতাহত হয় নি। চিৎকার এবং হৈচৈ শুনে প্রচুর লোকজন জমে যায় এবং যুবকটি পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। নীলক্ষেত পুলিশ-ফাঁড়ির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। ফাঁড়ি কর্তৃপক্ষ জানান যে, এই প্রসঙ্গে তাঁরা কিছুই জানেন না।
জাহিদ সাহেব খবরটা পড়লেন। কিন্তু তাঁর কোনো ভাবান্তর হল না। পত্রিকা খুললেই এ-জাতীয় খবর থাকে। বাংলাদেশের কোথাও-না-কোথাও কেউ-না-কেউ ত্রাসের সৃষ্টি করছে। একবার খবর বেরুল, ছোট-ছোট শিশুদের পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। একবার বেরুল, রক্তচোষার আগমন ঘটেছে। এরা কাউকে একা পেলেই ধরে বেঁধে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে সমস্ত রক্ত নিয়ে যাচ্ছে খলিলুল্লাহ্ বলে এক লোককে নিয়ে প্রচুর হৈচৈ হল। এই লোকটির প্রধান খাদ্য নাকি মৃত মানুষের কলিজা। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কতটুকু সত্যি কে জানে!
জাহিদ সাহেবের ধারণা, এ-জাতীয় খবরের বেশির ভাগই রিপোর্টাররা চা-সিগারেট খেতে খেতে তৈরি করেন। মানুষের কৌতুহল জাগিয়ে পত্রিকার কাটতি বাড়ান। এ জাতীয় খবরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, বেশ কয়েকটি ফলো আপ স্টোরি ছাপা হবে। এবং সবেশেষে একটি সচিত্র ফিচারের মাধ্যমে ঘটনার ইতি হবে। অতঃপর রিপোর্টাররা অন্য কোনো ভয়াবহ ঘটনা ফাঁদতে চেষ্টা করবেন–অজ্ঞাতনামা জন্তু বা এই জাতীয় কিছু।
কিন্তু নীলু এই খবরটি এভাবে দাগিয়েছে কেন? বর্তমানে নীলুর কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। সে কি সেই ক্ষমতার কারণেই কিছু আঁচ করছে?
দুপুরবেলা খাবার সময় জাহিদ সাহেব প্রসঙ্গটা তুললেন। হালকা গলায় বললেন, পুরানা পল্টনে আতঙ্ক, এই খবরটা তুই দাগিয়েছিস কেন?
নীলু জবাব দিল না। তার মুখ থমথমে। জাহিদ সাহেব বুঝলেন, নীলু এখন কোনো কথারই জবাব দেবে না। মাঝে-মাঝে সে এরকম চুপ করে যায়। প্রয়োজনীয় কথাটাও বলে না।
জাহিদ সাহেব মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিজের মনে বললেন, দরজা-টরজা ভালোমতো বন্ধ করে ঘুমানো উচিত। বলা তো যায়না। পল্টন আর কাঁঠালবাগান–খুব একটা দূরের ব্যাপার না।
তাঁর এ-সব বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে মেয়েকে আলোচনায় টেনে আনা। কিন্তু নীলু একটি কথাও বলল না। খাওয়ার মাঝখানেই সে উঠে চলে গেল।
জাহিদ সাহেব যা ভেবেছিলেন, তাই। ফলো-আপ স্টোরি ছাপা হয়েছে। খবর চলে এসেছে প্রথম পাতায় আকর্ষণীয় শিরোনাম।
নগ্নগাত্র বিভীষিকা
(স্টাফ রিপোর্টার)
পহেলা জুলাই, শনিবার, পুরানা পল্টন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী যুবক আবার আজ গভীর রাতে দেখা দিয়েছে। যথারীতি তার হাতে ছিল লোহার রড। এবার তার রডের আঘাতে রাহেলা নামী এক পতিতা গুরুতর আহত হয়। তার ডান হাত এবং পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে যায়। তাকে সোহরাওয়াদী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রাহেলার বর্ণনা অনুযায়ী রাত আনুমানিক দুই ঘটিকার সময় নগ্নগাত্র যুবক একটি সুঁচাল লোহার রড নিয়ে উপস্থিত হয় এবং—।
নীলু আজও খবরটির চারদিকে লাল পেনসিল দিয়ে দাগ দিল। তারপর বাবাকে খবরের কাগজটি দিয়ে বলল, বাবা, আমাকে একটা কাজ করে দেবে?
নিশ্চয়ই দেব। কাজটা কী?
আমি মিসির আলি স্যারকে চিঠি লিখেছি। ঐটি তাঁকে পৌঁছে দেবে। তিনি অবশ্যি এখনো ঢাকায় ফেরেননি। তুমি দরজার নিচ দিয়ে রেখে আসবে, যাতে আসামাত্র পেয়ে যান।
জাহিদ সাহেব বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। নীলু বলল, স্যারের খুব বিপদ। খালিগায়ে ছেলেটি স্যারকে মেরে ফেলবে। তাকে সাবধান করা দরকার।
বলিস কী!
আমি যা বলছি, ঠিকই বলছি। তুমি এক্ষুণি যাও। খামের ওপর ঠিকানা লেখা আছে। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু আমার ভালো লাগছে না।
জাহিদ সাহেব দেখলেন, খামের ওপর পুরানা পন্টনের ঠিকানা লেখা।
পুলিশ কমিশনার
পুলিশ কমিশনার রাত এগারটায় পুরানা পল্টন এলাকায় এলেন। থমথম করছে চারদিক। একটি ভিখিরিকেও দেখা গেল না। দোকানপাট পর্যন্ত বন্ধ। তিনি লক্ষ করলেন, একতলার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই এই প্ৰচণ্ড গরমেও জানালা বন্ধ করে শুয়েছে। আতঙ্কের মতো ভয়াবহ কিছুই নেই। এবং পুলিশের শাস্ত্ৰে আতঙ্কগ্ৰস্ত মানুষের মতো ভয়াবহ কিছুই নেই। মিছিলের মানুষজন হঠাৎ ক্ষিপ্তের মতো পুলিশের গাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কারণ রাইফেল হতে পুলিশকে দেখে তারা আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়।
সাজ্জাদ হোসেন গাড়ি থেকে নেমে সিগারেট ধরালেন। এ অঞ্চলে টহলপুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন তাদের জন্যে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলবেন। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হল, গোরস্থানের ভেতর কিছু ফিক্সড পোষ্ট সেন্ট্রি দেয়া দরকার। লুকিয়ে থাকার জন্যে গোরস্থান হচ্ছে আদর্শ জায়গা। কেউ কিছু টের পাবে না। একসময় আত্মগোপনকারী দেয়াল টপকে ঝাঁপিয়ে পড়বে অসতর্ক পথচারীর ওপর।