উত্তর : না, সাউণ্ড ঘুম। আমি ঘুমের মধ্যে আরেকবার নাড়ি দেখলাম। হার্টবিট বেশি ছিল, তবে আগের চেয়ে কম। কত ছিল তা মনে নেই।
প্রশ্ন : গায়ে টেম্পারেচার ছিল?
উত্তর : আমি যখন দেখি, তখন অল্প ছিল। নাইনটি নাইন পয়েন্ট ফাইভ। আমি চলর আসার সময় বলেছিলাম, সকালবেলা আবার দেখব। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। ভোয় পাঁচটার ট্রেনে রুগীকে নিয়ে তারা ঢাকা চলে যায়।
জহুরুল হক
বয়স ২০/২১। স্থানীয় কলেজের ছাত্র। বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট। চৌধুরীদের বাড়ি লজিং থাকে। এদের সঙ্গে ক্ষীণ আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। কথাবার্তা শুনে ধারণা হল, নাজনীন মেয়েটির প্রতি সে খানিকটা অনুরক্ত।
প্রশ্ন : ফিরোজের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল?
উত্তর : জ্বি-না। আমি একটু দূরে দূরে ছিলাম।
প্রশ্ন : দূরে-দূরে ছিলে কেন?;
উত্তর : আজমল ভাই সব সময় তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে থাকতেন। আমি আজমল ভাইকে সব সময় এড়িয়ে চলি। তাঁকে ভীষণ ভয় পাই। কাজেই…।
প্রশ্ন : ভয় পাও কোন?;
উত্তর : আজমল ভাই ভীষণ রাগী। চট করে রেগে যায়! ওদের ফ্যামিলির সবাই খুব রাগী। এখনো ওদের মধ্যে কিছুটা জমিদার-জমিদার ভাব আছে। সবাইকে মনে করে ছোটলোক।
প্রশ্ন : ফিরোজ কেন অসুস্থ হয়েছিল বলে তোমার ধারণা?
উত্তর : জানি না কেন হয়েছে। তবে লোকে বলে, ওরা ধুতুরার বীজ খাইয়ে পাগল করে ফেলেছে।
প্রশ্ন : বল কী তুমি!
উত্তর : না, আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। লোকে কী বলে, সেটা বললাম।
প্রশ্ন : লোকে এ-জাতীয় কথা কেন বলছে?
উত্তর : এদের পূর্বপুরুষরা খুব অত্যাচারী জমিদার ছিল। এরা মানুষের প্রাণ অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল। এরা প্রচুর অন্যায় করেছে, সেই জন্যেই এ-সব বলে।
প্রশ্ন : তুমি মনে হয়। এদের ওপর রেগে আছ?
উত্তর : না, রাগব কেন? সত্যি কথাটা আপনাকে বললাম।
মোহনগঞ্জে আসায় মিসির আলি সাহেবের তেমন কোনো লাভ হয় নি। এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি, যেটা তাঁর কোনো কাজে আসবে। চট করে অবশ্যি কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। খুঁজতে হয়। জট খোলবার প্রথম ধাপই হচ্ছে অনুসন্ধান। অধকারে হাতড়ানোর মতো কোনো আলোর ইশারা থাকতে হবে। সে-রকম কোনো আলোর সন্ধান মিসির আলি এখনো পান নি।
তবে যাবার দিন ভোরবেলায় একটি সূত্র পাওয়া গেল। অস্বস্তিকর একটি সূত্র, যাকে গ্রহণ করাও যায় না, আবার ফেলে দেয়াও যায় না। নাজনীন এসে বলল, চাচা, আসুন, আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাব।
কী মজার জিনিস?
আমাদের এক পূর্বপুরুষ পিতলের একটা কলসি পেয়েছিলেন। কলসিভর্তি ছিল মোহর। সেই মোহর পেয়েই তারা জমিদার হল।
কলসিটায় কোনো বিশেষত্ব আছে?
না। সাধারণ কলসি, তবে অমাবস্যার সময়ে এটা ঝন ঝন শব্দ করে।
তুমি নিজে শুনেছ?
না, তবে অনেকেই শুনেছে। আমি আর ভাইয়া এক অমাবস্যার রাতে কলসির পাশে জেগেছিলাম। কিছু শুনতে পাইনি।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, প্রাচীন মোহরভর্তি কলসি—এ-জাতীয় গল্প খুব প্ৰচলিত। তবে এ-সবের কোনো ভিত্তি নেই।
চাচা, অনেকেই কিন্তু শব্দ শুনেছে।
হয়তো ইদুর ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ইঁদুর শব্দ করেছে।
মিসির আলি কলসি দেখার জন্যে কোনোরকম আগ্রহ বোধ করলেন না। শুধুমাত্র নাজনীনের মনরক্ষার জন্যে সঙ্গে গেলেন। দোতলার উত্তরের সবচেয়ে শেষের ঘরটির তালা খুলল নাজনীন। মিসির আলির শিরদাঁড়া দিয়ে একটি ঠাণ্ড স্রোত বয়ে গেল। কলসিরকারণে নয়। এ-ঘরে কয়েকটি পুরনো পেইনটিং আছে। তাদের একটিতে খালিগায়ে একটি লোক ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট। চোখে সোনালি চশমা। শুকনো ধরনের কঠিন একটি মুখ।
নাজনীন, এ-ছবিটা কার?
আমার দাদার বাবা। উনি খালিগায়ে ঘোড়ায় চড়তেন।
নাম কি ওঁর?
মাসুক চৌধুরী।
ওঁর সম্পর্কে আর কী জান তুমি?
বিশেষ কিছু জানিনা। শুনেছি, খুব অত্যাচারী ছিলেন। তারপর একদিন সন্ধ্যাবেলা ঘোড়ায় চড়ে আসছিলেন। হঠাৎ প্রজারা তাঁকে ঘিরে ফেলে।
তারপর?
তারপর আবার কি? মেরে ফেলে। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারে।–চাচা, এই দেখুন কলসি। আবার কি কি যেন লেখাও আছে গায়ে। চেষ্টা করে দেখুন, পড়তে পারেন কি না। পালি ভাষায় লেখা।
লেখা পড়ার ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহ বোধ করলেন না। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোমার দাদার বাবাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারে?
হ্যাঁ। ওঁর কথা এত জিজ্ঞেস করছেন কেন?
এমনি জিজ্ঞেস করছি। আচ্ছা, ফিরোজ কি এই ঘরটি দেখেছে? সে কি এই ঘরে ঢুকেছিল?
জ্বি না।
কী করে বুঝলে ঢেকে নি?
কারণ, ঘরটা তালা দেয়া থাকে। এই তালার একটিমাত্র চাবি। সেই চাবি থাকে আমার কাছে।
জানালা-টানোলা দিয়ে এই ঘরে ঢোকার কোনো উপায় নেই, তাই না?
উঠার উপায় থাকলেই শুধু শুধু জানালা দিয়ে ঢুকতে যাবেন কেন? কী আছে এই ঘরে?
মিসির আলি দাঁড়িয়ে রইলেন ছবির সামনে। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমছে। তিনি জট খুলতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু জট খুলছে না। আরো পাকিয়ে যাচ্ছে। ফিরোজ যদি এক বার এই ঘরে ঢুকত, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটাই অনেক সহজ হয়ে যেত। তিনি বলতে পারতেন–ফিরোজ এই ছবিটি দেখেছে। তার মনে ছাপ ফেলেছে এই ছবি। পরবর্তী সময়ে ছবির মানুষটিকেই সে দেখেছে। হেলুসিনেশন। কত সহজ সমাধান।
কিন্তু ফিরোজ এই ছবি দেখে নি।
মিসির আলি বললেন, একটিমাত্ৰ চাবি?
হ্যাঁ।
তুমি কি নিশ্চিত যে এই ঘরের দ্বিতীয় কোনো চাবি নেই?