যে বটগাছের নিচে চশমাপরা লোকটির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, সেই গাছটিও তিনি দেখতে গেলেন। এবং গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হল, ঘটনাটি এখানে ঘটে নি। ফিরোজের বর্ণনা অনুসারে জায়গাটা নির্জন। দুএকটা পরিত্যক্ত হিন্দুঘরবাড়ি ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু বটগাছটা যে—অঞ্চলে, সে-জায়গাটা নির্জন নয়। পাশেই শিয়ালজানি খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকো, যার ওপর দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। নদীর ওপরেই কয়েক ঘর কুমোরের বাস! তাদের বাড়িভর্তি ছেলেমেয়ে, যারা খুব হৈচৈ করে খেলে। এই অঞ্চলটিকে নির্জন বলা চলে না।
ঘটনাটি নিশ্চয়ই অন্য কোথাও ঘটেছে এবং ফিরোজ ঘোরের মধ্যে হোটে-হেঁটে চলে এসেছে বটগাছের নিচে, যেখানে অন্য লোকজন তাকে দেখতে পায়।
মিসির আলি শিয়ালজানি খালের দুপার ধরে প্রচুর খোঁজাখুঁজি করলেন, কোনো বকুল গাছ পাওয়া যায় কি না। পাওয়া গেল না।
তাঁর দ্বিতীয় কাজ ছিল, এখানে আসার পর ফিরোজের সঙ্গে যাদের দেখা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আলাপ করা। জানতে চেষ্টা করা, তারা ফিরোজের আচার ব্যবহারে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছে কি না। দেখা গেল, খুব অল্পকিছু লোকজনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। কেউ তেমন কিছু বলে নি। মিসির আলি প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর ইন্টারভূর খুঁটিনাটি লিখে ফেললেন। কয়েকটি নমুনাঃ
মোসাম্মাৎ সালেহা বেগম
বয়স ৫০/৫৫! আজমল চৌধুরীর মা। পর্দানশিন। কম কথা বলেন। রাতে চোখে ভালো দেখতে পান না।
প্রশ্ন : ফিরোজ ছেলেটি কেমন?
উত্তর : ভালো।
প্রশ্ন : কেমন ভালো?
উত্তর : এত বড় লোকের ছেলে, কিন্তু অহঙ্কার নাই।
প্রশ্ন : বুঝলেন কী করে অহঙ্কার নেই?
উত্তর : আমার পা ছুয়ে সালাম করল।
প্রশ্ন : যে দিন সে অসুস্থ হয় সে-দিন, অথাৎ অসুস্থ হবার আগে কি তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
উত্তর : হয়েছিল, চা খাওয়ার সময়।
প্রশ্ন : কোনো কথা হয়েছিল?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ওকে দেখে কি আপনার একটু অন্যরকম লাগছিল?
উত্তর : না। তবে চোখ-মুখ ফেলা ছিল। রাতে ঘুম হয় নি, সে-জন্য বোধহয়।
প্রশ্ন : বুঝলেন কী করে, ওর রাতে ঘুম হয় নি? কারণ আপনার সঙ্গে তো ওর কোনো কথা হয় নি।
উত্তর : সে আজমলের কাছে বলছিল, তাই শুনলাম।
প্রশ্ন : আপনি জিজ্ঞেস করেন নি, কী জন্যে ঘুম হয় নি?
উত্তর : না।
নাজনীন সুলতানা
বয়স ২০/২১। মমিনুন্নেসা কলেজ থেকে বি. এ. পাস করে বাড়িতে আছে। অপরূপ
রূপবতী। মায়ের মতো স্বল্পভাষী নয়। ইনহিবিশন কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। লাজুক
নয়। কথাবার্তায় মনে হল অত্যন্ত জেদি, তবে হাসিখুশি ধরনের মেয়ে।
প্রশ্ন : কেমন আছ নাজনীন?
উত্তর : ভালো আছি। চাচা, আপনি এমন খাতা-কলম নিয়ে প্রশ্ন করছেন কেন? আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি কোনো পত্রিকায় ইন্টারভ্যু দিচ্ছি।
প্রশ্ন : ফিরোজকে তোমার কেমন লেগেছিল?
উত্তর : ভালো।
প্রশ্ন : কেমন তালো?
উত্তর : বেশ ভালো। (এই পর্যায়ে মেয়েটি ঈষৎ লজ্জা পেয়ে গেল।)
প্রশ্ন : ঠিক কী কারণে তুমি বলছ, বেশ ভালো?
উত্তর : জানি না। কী কারণে।
প্রশ্ন : ফিরোজ অসুস্থ হবার পেছনে কি কোনো কারণ আছে বলে মনে হয়?
উত্তর : এইসব নিয়ে আমি কখনো ভাবি নি চাচা।
প্রশ্ন : আচ্ছা, ফিরোজ অসুস্থ হয়ে তোমাদের বাড়িতে এল। সে-সময় তুমি তার সামনে গিয়েছিলে? তোমাকে কি সে চিনতে পেরেছিল?
উত্তর : চিনতে পেরেছিলেন কি না, তা তো চাচা বলতে পারব না। তবে উনি খুব হৈচৈ করছিলেন, আমাকে দেখে হৈচৈ থামিয়ে ফেলেন। রাতের বেলাও খুব চিৎকার শুরু করলেন। তখন ভাইয়া আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে চুপ করে গেলেন।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এখন আমি একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি। জবাব দিতে না চাইলে জবাব দিও না। প্রশ্নটি হচ্ছে—— ধর, ফিরোজ যদি এখন পুরোপুরি সেরে যায় এবং তোমাকে বিয়ে করতে চায়, তুমি কি রাজি হবে?
উত্তর : (খুব সহজ এবং শান্ত গলায়) হ্যাঁ, হব। চাচা, আজকের মতো থাক। আপনার জন্যে এখন শরবত নিয়ে আসি।–নাকি চা খাবেন? আপনি খুব ঘনঘন চা খাচ্ছেন—এটা কিন্তু চাচা ভালো না।
হরিপ্রসন্ন রায়
এম. বি. বি. এস.
স্থানীয় ডাক্তার। বয়স ৪০/৪৫। ব্যস্তবাগীশ লোক। এ অঞ্চলে তাঁর খুব পসার আছে। ইন্টারভ্যু, চলাকালেই দু জন লোক তাঁকে নিতে এল। কথা বেশি বলেন।
প্রশ্ন : আপনি কখন রুগীকে দেখতে এলেন?
উত্তর : আমাকে খবর পাঠিয়েছে পাঁচটায়। তখন যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ ধর্মপাশা থেকে এক জন পেসেন্ট এসেছে, এখন—তখন অবস্থা। পেটের ব্যথা।। আলসার ছিল, সেই পেইন, কাজেই আমি সন্ধ্যার পরে গিয়ে উপস্থিত হই। ধরুন ছটা সাড়ে ছাঁটা। শীতকাল তো ছাঁটার সময় চারদিক অন্ধকার।
প্রশ্ন : আপনি কী দেখলেন? মানে রুগীর অবস্থার কথা বলছি।
উত্তর : গো-গোঁ শব্দ করছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। হিস্ট্রিরিয়ার লক্ষণ মনে হল। চোখ বড়-বড় করে ঘোরাচ্ছিল। ভয়াবহ অবস্থা! আমি নাড়ি দেখলাম। হাৰ্টবিট ছিল খুব হাই। হিস্ট্রিরিয়াতে এ রকম হয়।
প্রশ্ন : অষুধপত্র কী দিলেন?
উত্তর : তেমন কিছু না। ঘুমের অষুধ দিয়েছি, ফেনোবারবিটন। তারপর বললাম ইমিডিয়েটলি ঢাকা নিয়ে যেতে।
প্রশ্ন : কতক্ষণ ছিলেন আপনি?
উত্তর : রাত দশটা পর্যন্ত ছিলাম। ওরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। নাজনীন কান্নাকাটি করছিল। কাজেই রুগী ঘুমিয়ে না-পড়া পর্যন্ত ছিলাম।
প্রশ্ন : ঘুমের মধ্যে রুগী কি কোনো কথাবার্তা বলছিল?