ফিরোজ ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে ডাকলেন, ফিরোজ। ফিরোজ জবাব দিল না। তার পায়ের কাছে ভারি লোহার রীড়াটি আছে। ব্লাডটি মাথা বেশ ধারাল। বারবার সেখানে চোখ আটকে যায়।
ওসমান সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তাঁর বারবার মনে হচ্ছে, এই লোহার রডটি ভয়ঙ্কর কোনোকিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে।
মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। তিনি নাকি ঢাকায় নেই। কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতে পারে না। কবে ফিরবেন, তাও কারো জানা নেই!
মোহনগঞ্জ স্টেশনে মিসির আলি
মোহনগঞ্জ স্টেশনে মিসির আলি নামলেন রাত সাড়ে সাতটায়। গায়ে প্রবল জ্বর। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা! চোখ মেলতে পারছেন না, এ-রকম অবস্থা। তাঁর নিজের বোকামির জন্যে এটা হয়েছে।
শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। কামরায় লেখা পাঁচশ জন বসিবেন।– বসেছে পঞ্চাশ জন। আরো পঞ্চাশ জন দাঁড়িয়ে! অসম্ভব গরম। বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে আসছে উৎকট দুৰ্গন্ধ। বারবার মিসির আলির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। নরকযন্ত্রণা বোধ হয় একেই বলে। যাত্রীদের মধ্যে এক জন রোগী আছে, যে কিছুক্ষণ পরপর গো-গোঁ শব্দ করছে। সেই শব্দ শুনে মনে হয়, এক্ষুণি বোধ হয় তার প্রাণবিয়োগ হবে। ভয়াবহ অবস্থা!
মিসির আলি শ্যামগঞ্জ নেমে পড়লেন। খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নেবেন, এ-আশায়। ট্রেন ছাড়ার সময় হঠাৎ মনে হল–ছাদে বসে গেলে কেমন হয়? অনেকেই তো যাচ্ছে। বাতাসের অভাব হবে না। সেখানে। গ্রামের ভেতর দিয়ে স্ট্রেন যাবে, টাটকা বাতাস পাওয়া যাবে। তিনি ছাদে উঠে পড়লেন।
ছাদের অবস্থা বেশ ভালো। চমৎকার হাওয়া! মিসির আলি নিজেকে ধন্যবাদ দিলেন, ঠিক সময়ে ঠিক সিন্ধান্তটি নেবার জন্যে।
সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। হিরণপুর আসবার আগেই আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। প্রবল বাতাস বইতে শুরু করল! ধরবার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। তাঁর মনে হতে লাগল, যে-কোনো মুহূর্তে তাকে উড়িয়ে নিয়ে চাষা খেতে ফেলবে। জীবনের ইতি হবে সেখানেই। বাতাসের সঙ্গে-সঙ্গে বর্ষণ। বৃষ্টির ফোঁটা সূচের মতো গায়োবিধছে। আর কী ঠাণ্ডা! যেন বরফের চাই থেকে গলে গলে পড়ছে।
একটা ভালো অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার কথা অন্যকে বলার মতো সুযোগ কি আর হবে? মিসির আলি বাতাসের কাপ্টা সামলাবার চেষ্টা করছেন। ছাদের ওপরে বসা মানুষগুলোর কেউ-কেউ আজান দিতে শুরু করেছে। আল্লাহকে খুশি করার একটা চেষ্টা। আল্লাহ্ খুশি হলেন কি না বোঝা গেল না।–ঝড়-বৃষ্টি কিছুই কমল না, তবে ড্রাইভার ট্রেন দাঁড় করিয়ে ফেলল। ছাদের ওপরে বসে-থাকা অসহায় মুলুঙ্গু আজানের শব্দ নিশ্চয়ই তার কানে গিয়েছে। আজানের ধ্বনি একেবারে বৃথা যায় নি।
ঝড় আধা ঘন্টার মতো স্থায়ী হল। এবং পরের কুড়ি মিনিটের মধ্যে মিসির আলির গায়ের তাপ হুহু করে বাড়তে লাগল! মোহনগঞ্জ স্টেশনে নেমে তাঁর মনে হল, প্লাটফরমেই শুয়ে পড়েন।
স্যার, আপনি কি মিসির আলি?
হুঁ।
আমি চৌধুরীবাড়ি থেকে আপনাকে নিতে এসেছি স্যার।
ও, আচ্ছা।
আপনি কোন টেনে আসবেন সেটা বলেন নাই, আমি সকাল থেকে সব কটা ট্রেন দেখছি।
খুব কষ্ট দিলাম-না?
জ্বি স্যার, তা দিলেন।
মিসির আলি হেসে ফেললেন। বেশ ছেলেটি। বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট। কথাবার্তায় কোনো গ্ৰাম্য টান নেই।
কি কর তুমি?
এখানকার কলেজে স্যার বি. এ. পড়ি। চৌধুরীবাড়িতে থাকি।
নাম কি তোমার?
জহুরুল হক।
জহুরুল হক সাহেব, চল রওনা হওয়া যাক।
চলুন। আপনার মালপত্র কোথায়?
মালপত্র কিছুই নেই। একটা হ্যাণ্ডব্যাগ ছিল, সেটা বাতাসে উড়ে গেছে।
বাতাসে উড়ে গেছে মানে?
ছাদে বসে এসেছি তো।–ঝড়ের মধ্যে পড়েছি।
বলেন কী! কী সৰ্ব্বনাশ!
শোনো জহুরুল-এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা কী? আমার কিন্তু হাঁটার ক্ষমতা নেই।
হাঁটা ছাড়া তো যাওয়ার অন্য কোনো ব্যবস্থাও নেই। নদীতে এখনো পানি হয়নি, নৌকা, চলে না।
মিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পথে নামলেন। সেখানে আবার তাঁকে বৃষ্টিতে ধরল।
তাঁর জ্বরের ঘোর কাটতে দু দিন লাগল। পুরোপুরি আচ্ছান্ন অবস্থা গেল এ দু দিন। সবকিছু স্বপ্নদৃশ্যের মতো। যা দেখেন, তাই মনে হয় কাটা-কাটা খণ্ডচিত্র। একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই।
একটি অপরূপা রূপবতী মেয়েকে প্রায়ই উদ্বিগ্ন মুখে তাঁর পাশে বসে থাকতে দেখেন। এই মেয়েটিই বোধহয় নাজনীন মেয়েটি মাথায় পানি ঢালে। মাথার চুল টেনে দেয় এবং অত্যন্ত নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে, চাচাজী, এখন কি একটু ভালো লাগছে? বলুন, ভালো লাগছে?
তাঁর ভালো লাগে না। তবু মেয়েটিকে সান্তনা দেয়ার জন্যে বলেন, ভালো লাগছে। মা, বেশ ভালো লাগছে।
এক জন বয়স্ক মহিলাকেও প্রায় সৰ্ব্বক্ষণই তাঁর ঘরের চেয়ারে বসে থাকতে দেখেন। ইনি বোধহয় নাজনীনের মা। এই মহিলাটি কথাটথা বলেন না।
চব্বিশ ঘন্টা থাকবার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন, তাকৈ থাকতে হল এক সপ্তাহ। চার দিনের দিন তিনি নিজের ঘর থেকে বেরুলেন এবং খানিকক্ষণ হাঁটাহাটি করে আবার জ্বর বাঁধিয়ে ফেললেন। সেই জ্বর পুরোপুরি ছাড়ল না কখনো। তবু এর মধ্যেই যে-সব কাজ করবার কথা, সব করলেন।
প্রথম কাজ ছিল ফিরোজ এসে যে-সব জায়গায় গিয়েছে, সে-সব জায়গায় যাওয়া।
দেখা গেল, সে খুব বেশি বেড়ায় নি। বাড়ি এবং শিয়ালজানি খাল-এ দুয়ের মধ্যেই তার গতিবিধি সীমিত ছিল। এক দিন শুধু উত্তরবন্ধ বিলে গিয়েছিল মাছ ধরা দেখতে। সেখানে সে নিজেই নেমেছিল মাছ মারতে। তখন শিং মাছ কাটা ফুটিয়ে দেয়। সে ভয়ে অস্থির হযে পড়ে। তার ধারণা, সাপে কেটেছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। কারণ, ঘটনাটি ঘটে তার অসুস্থ হবার আগের দিন। খুব সম্ভব ঘটনাটি তার মনের ওপর ছাপ ফেলে। রাতে তার একটু জ্বরজ্বরও হয়।