ফরিদা সহজ কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, গত তিন-চার দিন ধরে তুমি এ—রকম আচরণ করছি এবং আমার মনে হয় ফিরোজের কোনো- একটা ব্যাপার তোমাকে এফেক্ট করেছে। সেটা কী?
কিছুই না! ফিরোজের কোনো ব্যাপার নয়। ফিরোজ এখন সুস্থ।
না, সে পুরোপুরি সুস্থ হয় নি।
ফরিদার কণ্ঠ তীব্র ও তীক্ষ্ণ। ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। তিনি ভালো করেই জানেন, গত তিন দিন ধরে ফিরোজ খুবই অসুস্থ। তাঁর ধারণা, এই তথ্যটি তিনি একাই জানেন। এখন বুঝতে পারছেন, এ ধারণা সত্য নয়। ফরিদাও সেটি জানে।
ওসমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার জন্যে এক কাপ চা দিতে বল।
ফরিদা উঠলেন না। তিনি জানেন, ওসমান সাহেবের চায়ের পিপাসা হয় নি। আলোচনার মোড় ফেরাবার জন্যেই চায়ের প্রসঙ্গটা টেনে আনা। ওসমান সাহেব বললেন, আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি খুব দরকার।
এই কথাটিও শুধু-শুধু বলা। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ নিয়ে ওসমান সাহেব কখনো মাথা মামুনুর এত সময় নেই।
ফরিদা।
বল।
ফিরোজের বর্তমান অবস্থাটা তুমি জান?
জানি।
কখন জানলে?
চার দিন আগে।
আমাকে বল নি কেন? তুমিও তো জানতে! তুমিও তো আমাকে কিছু বল নি।
বাড়ির অন্যরা জানে?
জানি না। অন্যরা জানে কি না জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে নি।
মিসির আলি সাহেব জানেন? তাঁকে কিছু বলেছ?
না, আমি কিছু বলি নি।
আমার মনে হয়, তাঁকে ব্যাপারটা জানানো উচিত।
উচিত হলে জনাও।
আরো আগেই জানানো উচিত ছিল, তাই না ফরিদা?
ফরিদা কোনো জবাব না দিয়ে উঠে গেলেন। তাঁর মাথা ধরেছে। তিনি খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবেন। রোজ দুপুরবেলায় তাঁর মাথা ধরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হয়।
ওসমান সাহেব বারান্দায় উঁকি দিলেন। ফিরোজ ইজিচেয়ারে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চিন্ত আরামের ঘুম কে বলবে তাঁর এত বড় সমস্যা আছে।
সমস্যাটি ওসমান সাহেব তিন দিন আগে প্রথম লক্ষ করেন। রাত নটার দিকে রোজকার রুটিনমতো তিনি ফিরোজের ঘরে ঢুকলেন। ফিরোজ হাসিমুখে বলল, কি খবর বাবা?
কোনো খবর নেই! এলাম খানিকক্ষণ গল্পগুজব করতে। বেড়-টাইম গ্ৰসিপিং।
বস।
কী করছিস?
কিছুই করছি না। পড়ছি।
কী পড়ছিস?
গল্প উপন্যাস এইসব, সিরিয়াস কিছু নয়।
মাঝে মাঝে অবশ্যি গল্প-উপন্যাসও বেশ সিরিয়াস হয়।
তা হয়। তবে আমি পড়ি হালকা জিনিস। এখন পড়ছি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নৌকাডুবি।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস হালকা জিনিস। বলিস কি তুই?
বেচারা নোবেল প্ৰাইজ পেয়েছে বলেই যে তাঁকে ভারি-ভারি উপন্যাস লিখতে হবে, তেমন তো কোনো কথা নেই।
ফিরোজ হাসতে শুরু করল। সহজ স্বাভাবিক হাসি। এক জন অসুস্থ মানুষ এ— রকম ভঙ্গিতে হাসতে পারে না। ওসমান সাহেব নিজেও হাসলেন এবং ঠিক তখনি একটা জিনিস লক্ষ্য করলেন।
ফিরোজের বিছানার ওপর প্রায় আড়াই হাত লম্বা একটা লোহার রড পড়ে আছে।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, লোহার রডটা এখানে কেন?
ফিরোজ তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।
কে রেখেছে। এটা এখানে?
আমি।
কেন?
এমনি।
এমনি মানে? বিছানার ওপর কেউ লোহার রড রাখবে কেন? ব্যাপারটা কি?
ওসমান সাহেব লক্ষ করলেন, ফিরোজের মুখ কেমন যেন কঠিন হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। জ্বলজ্বল করছে।
দে আমার কাছে, বাইরে রেখে আসি।
না।
না মানে? এটা দিয়ে তুই কি কারবি?
ফিরোজ গম্ভীর গলায় বলল, বাবা তুমি এখন যাও, আমি ঘুমাব।
ই ঘুমাবি, ভালো কথা, কিন্তু লোহার রড পাশে নিয়ে ঘুমাতে হবে কেন?
ঘুমালে অসুবিধা কি? অসুবিধা কিছুই নেই। কিন্তু সবকিছুর একটা কারণ আছে। তুই কারণটা আমাকে বল।
না, বলব না।
ওসমান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ফিরোজের চোখ লাল হয়ে উঠছে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। ভারি-ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে। ওসমান সাহেবের মনে হল–সামথিং ইজ রং সামথিং ইজ ভেরি রং।
ফিরোজ।
জ্বি।
ব্রড পাশে নিয়ে ঘুমানোর কারণটা আমাকে বল। প্লিজ! তুই একটি বুদ্ধিমান ছেলে। কারণ নেই, এমন কিছু তোর পক্ষে করা সম্ভব নয়।
ফিরোজ টেনে-টেনে বলল, ও আমাকে রাখতে বলেছে।
কে রাখতে বলেছে?
ঐ লোক।
কোন লোক? তার নাম কি?
নাম জানি না।
লোকটা কে?
খালিগায়ের একটা লোক। কালো প্যান্ট পরা, চোখে চশমা। সোনালি ফ্রেমের চশমা।
ওসমান সাহেব কিছুই বুঝতে পারলেন না। কার কথা বলছে সে?
স্ক্রি,মিসির আদি স্যারকে ঐ লোকের কথা আমি বলেছি। উনি চেনেন।
আই সি।
সে আমাকে বলেছে, লোহার রড সবসময় সঙ্গে রাখতে। যদি না রাখি, সে রাগ করবে।
এই ব্যাপারগুলো কি তুমি মিসির আলি সাহেবকে বলেছ?
জ্বি-না।
বল নি কেন?
ঐ লোক আমাকে বলেছে এটা না বলতে।
আই সি।
বাবা, তুমি চলে যাও। আমার ঘুম পাচ্ছে।
মাত্র সাড়ে নটা বাজে। এখনই ঘুম পাচ্ছে কি? আরেকটু বসি। গল্প করি তোর সঙ্গে।
গল্প করতে ইচ্ছা করছে না। তুমি এখন যাও।
তিনি চলে এলেন, কিন্তু সারারাত তাঁর ঘুম হল না। তাঁর মনে হতে লাগল——
দরজায় একটা তালা লাগিয়ে রাখা উচিত, যাতে ফিরোজ কিছু বুঝতে না পারে। কিন্তু তালা লাগানোর সাহস তার হল না। তালা লাগানের ব্যাপারটা ফিরোজকে আরো এফেক্ট করবে। ভালোর চেয়ে মন্দ হবে বেশি।
ওসমান সাহেব ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা ফিরোজের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী নিশ্চিন্তেই না ঘুমাচ্ছে সে! কে বলবে সে অসুস্থ! কত সহজ, কত স্বাভাবিক ঘুমাবার ভঙ্গি। কোলের ওপর একটা বই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের-– স্বপ্ন লজ্জাহীন। উপন্যাসটি কেমন কে জানে? সুনীলের কোনো বই পড়েন নি। গল্প-উপন্যাস তাঁর পড়া হয়ে ওঠে না।