ভারি মজার গল্প। জাহিদ সাহেব গল্প শুনে হাসতে হাসতে বিষম খেলেন। নীলুর মতো গভীর মেয়েও হেসে ফেলল। এই কি সেই ছেলে?
জাহিদ সাহেব আজকাল বেশির ভাগ সময়ই বারান্দায় বসে এইসব কথা ভেবে ভেবে কাটান। দু-তিনটে পত্রিকা তার হাতের কাছে থাকে, সে-সব পড়া হয় না। পনের খণ্ড মুক্তিযুদ্ধের দলিল কিনেছেন। শখ ছিল গোড়া থেকে পড়বেন, তা পড়তে পারছেন না! ইচ্ছা করে না। মাঝে-মাঝে শুধু অষ্টম খণ্ডে চোখ বুলিয়ে যান। অষ্টম খণ্ড হচ্ছে অত্যাচার ও নিযািতনের কাহিনী। পড়তে-পড়তে তাঁর বুক হুহু করে।
আজও তাই করছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, নীলু। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু নিঃশব্দে চলাফেরা করে। হঠাৎ উপস্থিত হয়ে চমকে দেয়। জাহিদ সাহেব বললেন, কি খবর মা?
কোনো খবর নেই বাবা।
কোথাও বেরুচ্ছিস?
না।
নীলু বসল। তাঁর পাশের চেয়ারে। তিনি লক্ষ করলেন, নীলু। বেশ সাজগোজ করেছে। কপালে টিপ। সুন্দর একটি শাড়ি। খোঁপায় ফুল পর্যন্ত দিয়েছে। জাহিদ সাহেব বললেন, তোর স্যার তো আর এলেন না।
উনি এসেছিলেন। বাড়ি চিনতে পারেন নি। রিকশা করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দু বার গেলেন।
তুই দেখছিস?
নীলু কিছু বলল না। সে দেখে নি। না দেখেই বলেছে। খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জাহিদ সাহেব জানেন, অস্বাভাবিক হলেও এটা সত্যি। নীলু না-দেখেই অনেক কিছু বলতে পারে। কেমন করে পারে, তা তিনি জানেন না। জানতে চানও না। নীলুর এই অস্বাভাবিক ক্ষমতাকে তিনি ভয় করেন।
কোনোদিন ভোরবেলায় নীলু। এসে যদি বলে, বাবা, আজ তোমার দিনটি ভালো যাবে। আজ বিলুর চিঠি পাবে।
তিনি হাসতে চেষ্টা করেন, কিন্তু হাসি ঠিক আসে না।
চিঠির সঙ্গে ছবিও পাবে। সুন্দর-সুন্দর ছবি পাঠিয়েছে বিলু!
তই নাকি?
হ্যাঁ।
নীলু হাসে। এই নীলু আগের নীলু নয়। এই নীলুকে তিনি চেনেন না।
সাহেব বললেন, তোর স্যার এসেছিলেন, তাঁকে ডেকে ঘরে আনলি না কেন?
উনি নিজেই খুঁজে বের করবেন। আমাদের এই স্যার কোনো জিনিসই মাঝপথে ছেড়ে দেন না।
তাই নাকি ?
হ্যাঁ। খুব মেথডিকেল মানুষ। তোমার সঙ্গে তো বাবা ওঁর সাথে এক বার দেখা হয়েছিল।
আমার মনে নেই।
নীলু হাসতে-হাসতে বলল, স্যারটা খুব আনইমপ্রেসিভ। তাঁর কথা মনে না থাকারই কথা।
জাহিদ সাহেব নীলুর গলায় এক ধরনের আবেগ অনুভব করলেন। এই আবেগের কারণ কী? তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললেন, খুব গরম পড়েছে। এ-বছর।
নীলু বলল, প্রতি বছর গরমের সময় তুমি এই কথাটা বল। আবার শীতের সময় বল– এ বছর মারাত্মক শীত পড়েছে। বল না বাবা?
বলি বোধহয়।
আমরা বেঁচে থাকি বৰ্তমানকে নিয়ে। অতীতের কথা আমাদের কিছু মনে থাকে না।
কথাটা কি ঠিক? না, ঠিক নয়। কিছু-কিছু অতীত তার কালো সীল শক্ত করে বসিয়ে দেয়, কিছুতেই তা তুলে ফেলা যায় না। নীলুর বিয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি প্রথম তা লক্ষ করলেন। যে-কোনো আলাপ অল্প কিছুদূর এগোেনর পরই বরপক্ষের লোকজন জানতে পেরে যায়, তাঁর এই মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল একটি বাড়িতে! যে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সে এক জন ভয়াবহ খুনী। কিন্তু কাউকেই তিনি বিশ্বাস করাতে পারেন নি যে, সেই খুনী নীলুকে স্পর্শ করতে পারে নি। কোনো- এক রহস্যময়কারণেতার মৃত্যু হয়েছিল। পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টেডাক্তার অবশ্যি লিখেছিল–মস্তিষ্কে রক্তক্ষরসুন্টু নুসুম ঘুঘু, কিন্তু ছিদ্র সাহেব তা বিশ্বাস করেন না। তিনি জানেন মৃত্যুর কারণ অমীমাংসিতু এবং রহস্যময়।
সেই রহস্য তাঁর মেয়েকে এখনো ঘিরে আছে। তিনি তা চান না। তিনি তাঁর মেয়ের জন্যে একটি সহজ স্বাভাবিক জীবন চান। একটি ছোট্ট সুখী সংসার। দুটি শিশু–তিনি যাদের হাত ধরে পার্কে বেড়াতে যাবেন। বাদাম কিনে দেবেন। এক জন হঠাৎ পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে। তিনি কোলে নিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করবেন। তাই দেখে অন্যজনের হিংসা হবে। তাকেও কোলে নিতে হবে; কেউ তখন আর কোল থেকে নামতে চাইবে না। বড় ঝামেলায় পড়ে যাবেন তিনি।
তাঁর চিন্তায় বাধা পড়ল। নীলু। হেসে উঠল খিলখিল করে। পুরনো দিনের নীলুর মতো। জাহিদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, হাসছিস কেন?
তুমি কী অদ্ভুত সব কল্পনা কর বাবা!
নীলু হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। জাহিদ সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। এ কোন নীলু? এই ভয়ঙ্কর ক্ষমতার উৎস কী?
হানিফাকে পিজিতে ভর্তি
মিসির আলি হানিফাকে পিজিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মেয়েটি এক-একা থাকতে ভয় পাবে। কিন্তু হানিফা ভয় পেল না।
থাকতে পারবি তো?
হুঁ।
অনেক রকম পরীক্ষা-টরীক্ষা করবে। ডাক্তাররা। ভয়ের কিছু নেই।
আমি ভয় পাই না।
তিনি ভেবে দেখলেন, মেয়েটির ভয় না পাওয়ারই কথা। যে জীবন শুরু করেছে। রাস্তায়, তার আবার ভয় কিসের?
হানিফা।
জ্বি।
আমি দু দিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যাব। মোহনগঞ্জ যাব। তুই থাকতে পারবি তো?
পারব।
দু দিন পরই এসে পড়ব। এর মধ্যে ডাক্তাররা পরীক্ষা-ট্ররীক্ষা, যা করবার করবেন। তা ছাড়া আমি আমাদের বাড়িওয়ালাকে বলে যাব, তিনি খোঁজখবর করবেন।
খোঁজখবরের দরকার নাই।
দরকার থাকবে না কেন? দরকার আছে। যাই তাহলে, কেমন?
জ্বি আচ্ছা।
মিসির আলি বিমর্ষ মুখে বের হয়ে এলেন। মেয়েটির অসুখ তাঁকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন ডাক্তারের পরামর্শে ডাক্তারের ধারণা, হার্টসংক্রান্ত কোনো সমস্যা। ইসিজি টিসিজি করাতে হবে। হার্ট-বিট খুবই নাকি ইরেগুলার।