ওটা একটা কারণ। তা ছাড়া অন্য একটি কারণ আছে।
জানতে পারি?
নিশ্চয়ই পারেন। আমি এক জন রোগীর মনোবিশ্লেষণ করছি। এই মুহুর্তে আমার পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
সত্যি বলছেন?
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, মিথ্যা বলব কেন?
আপনি কি আপনার ডিসিসন ওদেরকে জানিয়েছেন?
আজই তো মাত্ৰ চিঠি পেলাম।
তবু আপনার উচিত ইমিডিয়েটলি আপনার ডিসিসন ওদের জানানো। হয়তো ওদের কোনো অলটারনেট ক্যানডিডেট আছে।
স্যার, আপনার কি সেখানে যাবার ইচ্ছা? ইচ্ছা থাকলে বলেন।
বলব মানে, আপনি কী করবেন?
নোয়েল আমার বন্ধুমানুষ। ইংল্যাণ্ডে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আমার তিনটা পেপার আছে যেখানে নোয়েল হচ্ছে এক জন কো-অথর। আপনার বোধহয় চোখে পড়ে নি।
সাইদুর রহমান সাহেবের মুখ তেতো হয়ে গেল। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন, সুইডেন কি একটা যাওয়ার মতো জায়গা? আছে কি সেখানে, বলুন? দেখার কিছু আছে? কিছুই নেই। একটা ফালতু জায়গা।
দেখাদেখিটা তো ইস্পটেন্ট নয়। সেমিনারটাই প্রধান। সারা পৃথিবী থেকে জ্ঞানীগুণীরা আসবেন।
ঐসব কচকচানি শুনে কোনো লাভ হয়? কোনোই লাভ হয় না। শুধু বড়-বড় কথা।
এটা ঠিক বললেন না। সেখানে যাঁরা আসবেন, তাঁরা কথার চেয়ে কাজ অনেক বেশি করেন। বিশেষ করে এমন কিছু লোকজন আসবেন, যাঁদের দেখলে পুণ্য হয়।
আপনিও তো ওদের নিমন্ত্রিত, তার মানে বলতে চাচ্ছেন, আপনাকে দেখলেও পুণ্য হবে?
মিসির আলি একটু হকচকিয়ে গেলেন। পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তা হবে। আপনি অনেকক্ষণ আমাকে দেখলেন। অনেক পুণ্য করলেন। উঠি স্যার?
ডঃ সাইদুর রহমান বহু কষ্টে রাগ সামলালেন। মনে-মনে এমন কিছু গালাগালি দিলেন, যা তাঁর মতো অবস্থার ব্যক্তিরা কখনো দিতে পারে না। এর মধ্যে একটি গালি ভয়াবহ।
নীলুর বাবা জাহিদ সাহেব
বছরখানেক হল নীলুর বাবা জাহিদ সাহেবের স্বাস্থ্য দ্রুত ভাঙতে শুরু করেছে। এমন কিছু অসুখ তাঁকে ধরেছে, যা শুধু কষ্টকর নয়, অত্যন্ত বিরক্তিকর। কিছুই হজম হয় না। পানি মেশান দুধ, লেবুর রস দিয়ে বার্লি, এক স্নাইস রুটি বা শিং মাছের মশলাবিহীন ঝোল–কিছুই না। ডাক্তার প্রায় সবই দেখানো হয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, লিভার কাজ করছে না। ডাক্তারদের শুকনো ধরনের কথাবার্তা, ইতস্তত ভাবভঙ্গি থেকে তাঁর ধারণা হয়েছে।–অসুখটা জটিল। হয়তো-বা লিভার ক্যানসারট্যানসার বাঁধিয়ে বসেছেন। ডাক্তাররা সরাসরি তাঁকে কিছু বলেন না। তিনিও জিজ্ঞাসা করতে ঠিক সাহস পান না। নীলুর সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা বলে না। তিনি কিছু একটা বলতে শুরু করলে মন দিয়ে শোনে, কিন্তু কথার মাঝখানে এমন একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে বসে যে, তাঁর ধারণা হয় নীলু আসলে কিছু শুনছে না। শুধু তাকিয়েই আছে।
নীলুকে ইদানীং তিনি ভয় করেন। যে-নীলু। তাঁর সঙ্গে থাকে, তাকে তাঁর নিজের মেয়ে বলে কখনো মনে হয় না। এ যেন একটি অচেনা মেয়ে—যাকে কোনোদিনই ঠিক চেনা যাবে না।
অবশ্যি নীলু। তাঁর সঙ্গে একেবারেই যে কথাবার্তা বলে না, তা নয়। কথাবার্তা বলে। এসে জিজ্ঞেস করে, চা লাগবে বাবা? এই পর্যন্তই। তিনি যদি বলেন লাগবে, তাহলে সে উঠে গিয়ে চা বানিয়ে কাজের ছেলেটির হাতে পাঠিয়ে দেবে। যদি বলেন লাগবে না, তাহলে চুপ করে যাবে। দ্বিতীয় কোনো কথা বলবে না।
জাহিদ সাহেব আজকাল তাঁর দ্বিতীয় মেয়েটির অভাব খুব অনুভব করেন। সে পাশে থাকলে বাসার অবস্থা হয়তো আরেকটু স্বাভাবিক হত। বিলুর বিয়েটা তিনি ভালো দিতে পারেন নি। অথচ তখন মনে হয়েছিল, কী চমৎকার একটি ছেলে। তিনি বারবার জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি দেশে চলে আসবে তো বাবা? বিদেশে সেটুল করবে না তো? আমি আমার মেয়েকে দেশান্তরী করতে চাই না। আমি একা মানুষ, আমি চাই আমার দুটি মেয়ে আমার আশেপাশেই থাকবে।
বিলুর বর হাসিমুখে বলেছে, বিদেশে সেটুলু করব কেন? কী আছে ওখানে? মানুষ হিসেবে কোনো দাম আছে আমাদের? আমি বছরখানেক থাকব। কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরব। মাথা গুজব্বার মতো একটা বাড়ি তো কিনতে হবে।
জাহিদ সাহেব ছেলের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু এখন জানতে পেরেছেন, সে মনটানাতে একটা বাড়ি কিনেছে। যে-ছেলে দেশে চলে আসবে, সে নিশ্চয় বিদেশে বাড়ি কেনে না। তা ছাড়া, বিলু সুখী হয় নি বলে তাঁর ধারণা। বিলুর চিঠিপত্রে অবশ্য কিছু লেখা থাকে না। কিন্তু চিঠিগুলো প্রাণহীন। যেন লেখার জন্যেই লেখা। দায়িত্ব পালনের চিঠি। এক জন সুখী মেয়ের চিঠিতে থাকবে আনন্দের ছবি। সে তার বরের কথাইনিয়ে—বিনিয়ে লিখবে। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে উদ্ধৃসি থাকবে। সে-সবকিছু থাকে না। বাবা হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি। সৎপাত্রে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেন নি। অথচ ছেলেটিকে সত্যি সত্যি তাঁর পছন্দ হয়েছিল। ভদ্র ছেলে। চমৎকার কথাবার্তা। দারুণ শাপ। সেই সঙ্গে রসিক। খাওয়ার টেবিলে একবার সে এক গল্প শুরু করল। এক দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকে এক ভণ্ড তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেছে। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে তর্কযুদ্ধ দেখতে! দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত মঞ্চে বসে আছেন।– ভও পণ্ডিত ঢুকল এবং গভীর হয়ে বলল,–ফুন ফুনাফুনি? দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তিনি তাঁর সারাজীবনে~~ফুন ফুনাফুন বলে কিছু শোনেন নি। এর মানে কী, তা তাঁর জানা নেই।