শেষরাতের দিকে হানিফার জ্বর কমে এল। শরীর ঘামতে লাগল। সে বিড়বিড় করে নানান কথা বলতে লাগল। মেয়েটির বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো থেকেই মিসির আলি বড় ধরনের একটি আবিষ্কার করলেন। তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না।
এই প্রসঙ্গে যথাসময়ে বলা হবে।
সাইকোলজি বিভাগের সভাপতি
সাইকোলজি বিভাগের সভাপতি ডঃ সাইদুর রহমানের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। মেজাজ খারাপের প্রধান দুটি কারণের একটি হচ্ছে–সুইডেনে একটি কনফারেন্সে তাঁর যাবার খুব শখ ছিল, কিন্তু আমন্ত্রণ আসেনি। তিনি চেষ্টা তদবিরের তেমন কোনো ত্রুটি করেন নি। যেখানে একটা চিঠি দেয়া দরকার, সেখানে তিনটি চিঠি দিয়েছেন। প্রফেসর নোয়েল বার্গকে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের নমুনা হিসাবে একটি চটের ব্যাগ পাঠিয়েছেন, যেটা কিনতে তাঁর তিনশ টাকা লেগেছে। রাজশাহীতে তৈরি খুব ফ্যান্সি ধরনের ব্যাগ। প্রফেসর নোয়েল বার্গ একটি চিঠিতে ব্যাগের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কিন্তু বহু প্ৰতীক্ষিত নিমন্ত্রণের চিঠি পাঠান নি।
সাইদুর রহমান সাহেবের মেজাজ খারাপের দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে–মিসির আলিসংক্রান্ত সমস্যা। মিসির আলি লোকটিকে তিনি মনেপ্ৰাণে অপছন্দ করেন। পার্টটাইম টীচার হিসেবে মিসির আলির অ্যািপয়েন্টমেন্টের বিপক্ষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। লাভ হয়নি। অ্যাপিয়েন্টমেন্ট হয়েছে। এবং অ্যাপিয়েন্টমেন্টের সময় ভাইসচ্যান্সেলর সাহেব বলেছেন, কোনো পোষ্ট অ্যাডভারটাইজ হওয়ামাত্র তাঁকে নেয়া হবে। সাইদুর রহমান সাহেব গত দু বছরে কোনো পোষ্ট অ্যাডভারটাইজড হতে দেন নি। এডহক ভিত্তিতে এক জনকে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন।
তাঁর ধারণা ছিল এডহক অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে মিসির আলি হৈচৈ করবেন। কিন্তু মিসির আলি কিছুই করেন নি। এটাও একটা রহস্য! এই লোকটির কি জীবনে উন্নতি করবার কোনোরকম ইচ্ছা নেই, না তার সবটাই ভান?
মিসির আলির ওপর আজ ভোরবেলায় তাঁর রাগ চরমে উঠেছে। কারণ তিনি দেখেছেন, সুইডেন থেকে মিসির আলির নামে একটি খাম এসেছে। তাঁর ধারণা, এটা কনফারেন্সের নিমন্ত্রণপত্র। কারণ, প্রেরকের নামের জায়গায় প্রফেসর নোয়েল বার্গের নাম আছে। প্রফেসর নোয়েল বাৰ্গ হচ্ছেন কনফারেন্সের আহ্বায়ক।
সাইদুর রহমান সাহেব অফিসে খোঁজ নিলেন–মিসির আলি এসেছেন কি না। জানা গেল, তিনি এসেছেন। কাজেই সুইডেনের সেই খাম নিশ্চয়ই খোলা হয়েছে। সাইদুর রহমান সাহেব হেড ক্লার্ককে বললেন, মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে যদি দেখা হয়, তাহলে বলবেন, আমি খোঁজ করছিলাম।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তাঁকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না। ডিপার্টমেন্টে আসেন না নাকি?
ক্লাস না থাকলে আসেন না।
গতকাল এসেছিলেন?
জ্বি, গতকাল এসেছিলেন। এক জন ছাত্রীর ঠিকানা খুঁজে বের করবার জন্যে খুব হৈচৈ করলেন।
তই নাকি?
জ্বি স্যার। নীলুফার ইয়াসমিন। সে দেড় বছর ধরে ইউনিভার্সিটিতে আসে না, এখন তার ঠিকানা খোঁজার জন্যে যদি অফিসের সব কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে তো মুশকিল।
কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হবে কেন? এ—সব পাসোনাল কাজের জন্যে তো অফিস না। আপনি স্ট্রেইট বলে দেবেন।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তা ছাড়া এক জন টীচার ছাত্রীর ঠিকানার জন্যে ব্যস্ত হবে কেন? এ-সব ঠিক না। নানান রকমের কথা উঠতে পারে।
মিসির আলি ভেবেই পেলেন না, ইউনিভার্সিটির এক জন ছাত্রীর ঠিকানা বের করা এত সমস্যা হবে কেন? অফিসে নেই। অফিস থেকে বলা হল, সমস্ত রেকর্ডপত্র উীন অফিসে। ভীন অফিসে গিয়ে জানলেন, রেকর্ডপত্র আছে রেজিষ্টার অফিসে। রেজিস্ট্রর অফিসে যে কেরানি এসব ডীল করে, দু ঘন্টা অপেক্ষা করেও তার দেখা পাওয়া গোল না। সকালবেলা সে নাকি এসেছিল। চা খেতে গিয়েছে। মিসির আলি রেজিষ্টার অফিসের ক্যান্টিনেও খুঁজে এলেন। দেখা পাওয়া গেল না। আবার আসতে হবে আগামীকাল।
ডিপার্টমেন্টে ফিরে এসে শুনলেন–সাইদুর রহমান সাহেব তাঁকে খোঁজ করেছেন। মিসির আলি বিস্মিত হলেন। সাইদুর রহমান সাহেব তাঁকে পছন্দ করেন না। বড় রকমের প্রয়োজনেও তাঁর খোঁজ করেন না। আজ করছেন কেন?
স্লামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনি কি আমার খোঁজ করছিলেন?
বসুন মিসির আলি সাহেব। আছেন কেমন?
ভালো।
মিসির আলি বসলেন।
কি জন্যে ডেকেছিলেন?
তেমন কিছু না।
সাইদুর রহমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। সুইডেনের চিঠির প্রসঙ্গ তুলবেন কি না বুঝতে পারলেন না! তুললেও এমনভাবে তুলতে হবে, যাতে এই লোক বুঝতে না পারে, তিনি এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী।
মিসির আলি বললেন, স্যার, আপনি কি কিছু বলবেন?
তেমন ইস্পটেন্ট কিছু না। সুইডেনের কনফারেন্সের খবর কিছু জানেন? মানে আমার যাবার কথা ছিল। পেপারের অ্যাবস্ট্রাক্ট পাঠিয়েছিলাম প্রফেসর নোয়েলের কাছে।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, আমি ওদের ইনভাইটেশন পেয়েছি। পেপার দেবার জন্যে বলছে।
তাই নাকি?
সাইদুর রহমান সাহেব নিভে গেলেন। টেনে-টেনে বললেন, যাচ্ছেন। কবে নাগাদ? এক সপ্তাহের ভেতরই তো রওনা হওয়া উচিত?
আমি যাচ্ছি ন স্যার।
কেন?
আমার কাজের মেয়েটি অসুস্থ।
সাইদুর রহমান সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কাজের মেয়ে অসুস্থ, এই জন্যে সে সুইডেন যাবে না। বদ্ধ উন্মাদ নাকি!
কাজের মেয়ে অসুস্থ, সেই কারণে যাচ্ছেন না?