অরু আপার আব্বা বললেন, তাই তো মনে হচ্ছে। এত বড় একটা মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমণ করে তার একটা পার্ট উড়িয়ে দেয়া সোজা কথা?
আম্মা বললেন, আহা, কোন মুক্তিযোদ্ধার গায়ে গুলী লেগেছে কি না কে জানে। খোদা বাঁচিয়ে রাখ তুমি ছেলেদের।
অরু আপাও আছেন সবার মাঝে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, দেখলি ইবু কেমন যুদ্ধ করল, মুক্তিবাহিনী!
আমি চুপ করে রইলাম। অরু আপা বললেন, একেবারে যাকে বলে ফাটাফাটি! আমি তবু চুপ করে রইলাম। অরু আপা একটু অবাক হয়ে বললেন, কি হল কথা বলছিস না কেন?
আমার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল। অরু আপা নিচু হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, তোর মুখে কালি কেন?
আমি জানতাম না, নিশ্চয়ই মেশিনগানের বারুদ। হাত দিয়ে মোছার চেষ্টা করলাম, অরু আপা তার ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আমার চোখে পানি। অবাক হয়ে বললেন, কি হল ইবু? কঁদেছিস কেন?
আমি চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
অরু আপা হঠাৎ একটা সন্দেহ করলেন। খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করে হাত ধরে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন। তারপর গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করলেন, তুই আবার বাসা থেকে পালিয়েছিলি?
আমি কোন কথা বললাম না।
তুই যুদ্ধটা দেখে এসেছিস কাছে থেকে?
আমি মাথা নিচু করলাম, হঠাৎ অরু আপা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, যুদ্ধে কি কারো কিছু হয়েছে?
আমি চুপ করে রইলাম। অরু আপ চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন, বললেন, শফিক? শফিকের কিছু হয়েছে?
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি বের হয়ে এল।
অরুণ আপা এক পা পিছনে সরে এসে দেয়ালটা ধরে নিজেকে সামলে নিলেন।
বারান্দায় তখনো সবাই দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লাল অ্যাংগুন মনে হয় আকাশকে ছুঁয়ে ফেলবে। মুক্তিবাহিনীর আগুন। কেউ জানতে পারুল না। অরু আপার পথিবী কেমন করে ধ্বসে পড়ছে সেই আগুনের সাথে সাথে।
বেলা দশটার দিকে মাইক দিয়ে একজন মানুষ ঘোষণা করতে করতে গেল যে শহরের অবস্থা শাস্ত, ভয়ের কারণ নেই। যে সব দুষ্কৃতকারী এসেছিল বীর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়। একজনকে জ্যান্ত ধরা হয়েছে। গুলীবিদ্ধ সেই দুষ্কৃতকারীকে কিছুক্ষণের মাঝে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে আসা হবে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইসলামিক দেশকে খণ্ডবিখণ্ড করার ঘূণ্য ষড়যন্ত্র করার অপরাধের জন্যে ভারতের অনুচর। এই দুষ্কৃতকারীকে দৃষ্টাস্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। সেই শাস্তিদৃশ্য নিজের চোখে দেখার জন্যে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজরফ আলী সবাইকে ঈদগাহে উপস্থিত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
মাইকের ঘোষণাটি শূনে আমার সারা শরীর কাঁপিতে থাকে। ভারতের অনুচর আর দুষ্কৃতকারী বলতে এরা বোঝাচ্ছে শফিক ভাইকে। শফিক ভাই নূর মুহম্মদের বেকারী থেকে পালাতে পারেন নি, মিলিটারীরা তাঁকে ধরে ফেলেছে। এখন শান্তি কমিটির লোকেরা মিলে তাকে সবার সামনে খুন করবে? খুন করবে? শফিক ভাইকে খুন করবে?
আমার হঠাৎ সারা শরীর গুলিয়ে উঠল, কিছু বোঝার আগে আমি হড়হড় করে বমি করে ফেললাম। আম্মা ছুটে আমাকে ধরলেন, কি হয়েছে। বাবা? হঠাৎ কি হয়েছে?
ভাইকে মেরে ফেলবে!
কি বলছিস তুই?
হ্যাঁ আম্মা। শফিক ভাই কাল রাতের যুদ্ধে গুলী খেয়েছেন।
তুই তুই কেমন করে জানিস?
আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম, আম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আস্তে আস্তে বললেন, হায় খোদা, এ তুমি কি করলে খোদা?
রাশেদ এল এগারটার দিকে। সে ঈদগাহের মাঠ হয়ে এসেছে। সেখানে একটা গাছ থেকে লম্বা একটা ফাঁসির দড়ি ঝোলানো হয়েছে। রাজাকাররা জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। আজরফ আলী এসে গেছে, শফিক ভাইকে আনলেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা শফিক ভাইকে বাচাতে চেষ্টা করবে না।
জানি না। নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু কেমন করে করবে?
তাহলে?
যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা হয়তো ধরে রেখেছে। অনেকে এভাবে মারা যাবে। রাশেদ বিষন্ন মুখে বলল, আমি জানি না।
আমরা চুপ করে বসে রইলাম। রাশেদ আস্তে আস্তে বলল, আমি কি করেছি জানিস?
কি?
যারা ওখানে মজা দেখতে এসেছে তাদেরকে বলেছি যে শোনা যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সুইসাইড স্কোয়াড ঈদগাহে আসছে। ভয়ংকর গোলাগুলী হবে। নিজেরাও মরবে যারা আছে তাদেরকেও শেষ করে দেবে।
বানিয়ে বলেছিস?
না। পুরোটা বানিয়ে বলি নাই।
তাহলে?
রাশেদ হাত নেড়ে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করিস না। কিন্তু জানিস, যখন খবরটা শান্তি বাহিনীর কাছে গেছে তখন হঠাৎ করে ভয় পেয়ে গেছে, লোকজন সরে যাচ্ছে।
তাহলে কি শফিক ভাইকে এখন মারবে না?
জানি না।
ঠিক তখন আবার মাইকে ঘোষণা দিতে দিতে একটা ক্লিক্সা আসতে থাকে। ঘোষণায় বলা হয় বিশেষ কারণে দুস্কৃতিকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে তারা এখন যেন ঈদগাহে না যায়। নতুন করে সময় ঘোষণা করা হবে।
রাশেদ আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমার খবরটা কাজে দিয়েছে মনে হয়, শফিক ভাই এখন জানে বেঁচে গেলেন।
কিন্তু কতক্ষণ?
জানি না।
সারাদিন আমাদের শহরটাতে হেলিকপ্টার আসতে লাগল। মিলিটারী নিশ্চয়ই অনেক মারা পড়েছে, অনেক আহত হয়েছে। যারা বেশি আহত তাদেরকে হেলিকপ্টারে সরিয়ে নিচ্ছে। রেল স্টেশনে কাউকে যেতে দিচ্ছে না। স্পেশাল ট্রেন এসেছে একটা, অনেক মিলিটারী নেমেছে সেই ট্রেন থেকে। ষ্ট্রেচারে করে অনেক মৃতদেহ তোলা হচ্ছে ট্রেনে। অস্ত্রগারটা যখন উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের স্কুলের একটা অংশও নাকি উড়ে গেছে। স্কুলের লাইব্রেরী ছিল সেটা, কত মজার বই ছিল সেখানে।