এই গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও মূল ঘটনাধারাকে নিয়ে লেখা। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের যে সব নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে আমি জড়িত হয়ে পড়েছিলাম এবং এই সংগ্রামের সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যে দিকগুলি সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম, সেগুলিকে ভিত্তি করেই ১৯৭২ সালে এই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তৈরি করা হয়। পরে সেই ভিত্তির সমপ্রসারণ ঘটে। মূল ঘটনাপ্রবাহ ও তার জটিল বিস্তার অনুধাবনের পক্ষে সহায়ক হতে পারে, মুখ্যত এই বিবেচনা থেকে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির উল্লেখ এই গ্রন্থে করা হয়েছে। কাজেই সমগ্র কর্মকাণ্ডের অনুপাতে এগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব নগণ্য বলে মনে করা হলে আমার কোন আপত্তি নেই। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার ব্যাপ্তি বিশাল, উপাদান অত্যন্ত জটিল এবং অসংখ্য ব্যক্তির আত্মত্যাগ ও অবদানে সমৃদ্ধ। এই সমস্ত কিছুর উল্লেখ ও বিবরণ এই গ্রন্থের বর্তমান কলেবরে সম্ভব ছিল না। এর ফলে কারো অবদান খর্বিত বা অনুল্লেখিত হয়ে থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং তজ্জন্য আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। একাত্তরের সংগ্রামের মূল উপাদান ও তথ্যাদি যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে, সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং সময় ও ঘটনার পারম্পর্য অক্ষুণ্ণ রেখে উপস্থাপন করাই এই গ্রন্থের প্রয়াস।
এই গ্রন্থের আলোচিত সময় ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারীতে শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকাল পর্যন্ত। একাধিক কারণে এই সময়কে একটি অখণ্ড কাল হিসেবে আমি গণ্য করেছি। আগের ইতিহাসের সামান্য পটভূমি স্পর্শ করা ব্যতীত এই গ্রন্থের বর্ণনাকে উপরোক্ত সময়ের অনুশাসনে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। সম্ভবত এর ফলে এই সময়কে তার নিজস্ব আলোকে উপলব্ধি করা সহজতর হবে।
ঘটনার চৌদ্দ বছর পর এই রচনা সমাপ্ত হতে চলেছে। দীর্ঘকালের ব্যবধানে স্মৃতি প্রায়শই অনির্ভরযোগ্য। কাজেই এই গ্রন্থ রচনাকালে অসমর্থিত স্মৃতিকে পরিহার করার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এবং সেই ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে গ্রন্থ রচনার প্রথম উদ্যোগকালে, ১৯৭২ সাল থেকে। পরবর্তী চার বৎসরে, বিক্ষিপ্তভাবে হলেও যে গবেষণার চেষ্টা আমি করেছিলাম তার ফলে দলিলপত্র, সাক্ষাৎকার, ব্যক্তিগত জার্নাল, মুদ্রিত তথ্য, ঘটনাপঞ্জি প্রভৃতি অনেক কাগজপত্র জমে ওঠে। এগুলি বিস্মৃতির ক্ষতিপূরণে বহুলাংশে সহায়ক হয়েছে। গত দু’বছরে এই গ্রন্থ রচনাকালে আরও কিছু নতুন তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। গ্রন্থে পরিবেশিত তথ্যাদির সূত্র বা উৎস কোন কোন ক্ষেত্রে অনুল্লেখিত থাকলেও এগুলির সত্যতা ও নিরপেক্ষতা যতদূর সম্ভব পুনর্বার যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছি। তৎসত্ত্বেও যদি তথ্যের কোন ভুলভ্রান্তি থাকে তার দায়িত্ব একান্ত ভাবেই আমার। গ্রহের পাদটীকায় ‘একান্ত সাক্ষাৎকার হিসাবে পরিবেশিত তথ্য ও অভিমতগুলি আজও অন্যত্র অপ্রকাশিত এবং বর্তমান রচনার জন্যই বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত।
এই গ্রন্থের রচনা, প্রকাশনা এবং বিশেষ করে, সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি গবেষণাকালে যাদের অকৃপণ সহযোগিতায় আমি উপকৃত হয়েছি তাদের নামের তালিকা দীর্ঘ। এঁদের অনেকে আজ লোকান্তরিত। এঁদের সবার কাছে আমি ঋণ স্বীকার করি।
মঈদুল হাসান
ঢাকা, ১৮ই ডিসেম্বর, ১৯৮৫
.
দ্বিতীয় সংস্করনের ভূমিকা
এই গ্রন্থের প্রথম প্রকাশ ও বর্তমান সংস্করণের মাঝে বিশ্বে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে তা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে যে বৈরিতামূলক ব্যবস্থা, ঠাণ্ডাযুদ্ধের যে উন্মত্ততা বহাল ছিল পৃথিবী জুড়ে, ইতিমধ্যে তার বহুলাংশের বিলোপ ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। এই বিশাল পরিবর্তন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তির ক্ষেত্রকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে, যা দু’বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। এই সংস্করণ প্রকাশকালে পরিস্থিতি ও দৃষ্টিভঙ্গির এ সমুদয় পরিবর্তনের মধ্যে যতখানি প্রাসঙ্গিক তা আমি বিবেচনায় রেখেছি। আমার মনে হয়েছে, এই সংস্করণে প্রথম প্রকাশের বর্ণনা ও যুক্তিবিন্যাস অনেকখানিই অপরিবর্তিত রাখা যায়। অপরিবর্তিত রাখার বড় কারণটি অবশ্য পদ্ধতিগত–মুক্তিযুদ্ধকে তার নিজস্ব সময়ের যুক্তিতে উপস্থাপন করার প্রয়োজন বোধহয় সব সময়েই থাকবে, অন্যদিকে যেমন বিভিন্ন সময় ও পরবর্তী অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধ উপস্থাপিত বা বিশ্লেষিত হতে পারে বিভিন্নভাবেই।
কাজেই সংশোধন বা পরিবর্তন এই সংস্করণে বড় কিছু নেই। সংযোজন যতটুকু করা হয়েছে তা পূর্বে উল্লেখিত ঘটনা বা যুক্তিকে অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যেই। এ যাবত অপ্রকাশিত কিছু দলিল পরিবেশন করা হল এই সূত্রে। আর কিঞ্চিৎ পরিমার্জনা করা হয়েছে কিছু ভাষার। লেখক
জানুয়ারী ১৯৯২