তাজউদ্দিন দেখতে পান, অমীমাংসিত পাক-ভারত যুদ্ধ এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নই কেবল বেশ কিছুকালের জন্য চাপা পড়বে তা নয়, অধিকন্তু বিশ্ববাসীর কাছে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম নিছক ‘ভারতীয় চক্রান্তের অংশ হিসাবে পরিগণিত হবে। তা ছাড়া বিঘোষিত স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলতে হলেও বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন-তার আগে কোন হঠকারিতা নয়। জাতীয় প্রস্তুতির এই অন্তর্বর্তীকালে ভারতের স্বীকৃতির প্রশ্নকে তাজউদ্দিন কেবল দাবী হিসাবে জীবিত রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন-উপযুক্ত সুযোগ ও সময়ের প্রতীক্ষায়। তাজউদ্দিনের এই উপলব্ধি অবশ্য তার অধিকাংশ সহকর্মীর কাছে গৃহীত হয়নি-যাঁদের দাবীই ছিল ভারতের তৎদণ্ডেই কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবিলম্বে যুদ্ধ যাত্রা।
সামরিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারত যে সেই সময় কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে অক্ষম, এই উপলব্ধির ভিত্তিতে পাকিস্তানী শাসকেরা ভারতের সকল প্রতিবাদ ও সতর্কবাণী উপেক্ষা করে দেশের আনাচে কানাচে ‘পরিষ্করণ অভিযান’(clearing operation) চালিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে চলে। নিধন ও নির্যাতনের পাশাপাশি বাঙালী জাতীয়তাবাদ সমর্থক সকল মানুষ এবং ব্যাপকতম অর্থে সংখ্যালঘু হিন্দুদের দেশ থেকে বিতাড়ন করে বাংলাদেশ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে নিযুক্ত হতে তাদের দেখা যায়।
কিন্তু ব্যাপক সংখ্যায় শরণার্থী সৃষ্টিই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির উপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ক্রমশ এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। শরণার্থীদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, জনসঙ্, স্বতন্ত্র ও হিন্দু মহাসভার মত ভারতের দক্ষিণপন্থী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলিও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যথোচিত ‘বলিষ্ঠতা’ প্রদর্শনের দাবীতে ততবেশি সোচ্চার হতে থাকে। কাজেই যথাশীঘ্র সকল শরণার্থীকে স্বদেশে ফেরৎ পাঠাতে না পারলে গোটা পরিস্থিতি যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের জন্য এক মারাত্মক রাজনৈতিক ফাঁদে পরিণত হতে পারে, সে ইঙ্গিত তখন মোটামুটি স্পষ্ট। সম্ভবত এক অমীমাংসিত যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে কংগ্রেস সরকারকে রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করা ছিল এই সব চরম দক্ষিণপন্থী ভারতীয় দলগুলির বাংলাদেশ প্রীতির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য।
অন্যদিকে পাকিস্তানের উপর প্রভাব আছে এমন সব রাষ্ট্রের চাপে বা সৎপরামর্শে পাকিস্তান যে সামরিক নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথ ধরবে, এমন আশা বজায় রাখাও ভারতের জন্য ক্রমশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। সরকারী পর্যায়ে একমাত্র সোভিয়েট ইউনিয়নের জোরাল নিন্দা ও প্রতিবাদ ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের অথবা গোপন সমর্থকের। অবশ্য চীনের ভূমিকা ছিল প্রকাশ্য এবং মূলত তা পাকিস্তানের শাসকদেরই পক্ষে।
এহেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে অন্তহীন শরণার্থীর স্রোত ভারতের জন্য সৃষ্টি করে এক কঠিন বাধ্য-বাধ্যকতা। শরণার্থীসৃষ্ট এই বাধ্যবাধকতার ফলে বাংলাদেশের বিপর্যস্ত মুক্তিবাহিনীকে নতুন ভিত্তিতে এবং বর্ধিত কলেবরে গড়ে তোলার অসামান্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সঙ্কটের উপযুক্ত সমাধান অন্বেষণকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ সংগ্রাম যাতে সম্পূর্ণভাবে না থেমে যায়, এ মর্মে ন্যূনতম ব্যবস্হা হিসাবে ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দানের প্রয়োজন ভারতের কর্তৃপক্ষমহলে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩০শে এপ্রিল। ৯ই মে তাদের হাতে ন্যস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানেচ্ছু বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিংদানের দায়িত্ব। এপ্রিল মাসে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) বিক্ষিপ্তভাবে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যে অল্প স্বল্প সাহায্য করে চলেছিল তার উন্নতি ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত চার সপ্তাহ মেয়াদী এই ট্রেনিং কার্যক্রমের মান অবশ্য ছিল নেহাতই সাধারণ-মূলত শেখানো হত সাধারণ হাল্কা-অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় দু’হাজার ছাত্র ও যুবকের প্রথম দলের ট্রেনিং।
অন্য অর্থে মে ছিল নিদারুণ হতাশার মাস। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অভিযানের মুখে মার্চ-এপ্রিলের স্বতঃস্ফুর্ত বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম ক্রমশ থেমে যাওয়ায় দেশের ভিতরে ও বাইরে সর্বত্রই নিরুৎসাহের ভাব। মধুপুর, গোপালগঞ্জ এবং আরও দু’একটা ছোটখাট অঞ্চল বাদে গোটা বাংলাদেশ পাকিস্তানী সেনাদের করতলগত। দেশের অভ্যন্তরে সর্বত্রই সামরিক সন্ত্রাস। তাদের সহযোগী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগে গঠিত ‘শান্তি কমিটি’র তৎপরতার ফলে স্বাধীনতা-সমর্থক সবার পক্ষেই নিরাপদে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। যে সব বিদ্রোহী সেনা পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে স্বজন-পরিজন ফেলে ভারতে এসেছিল অস্ত্রশস্ত্রের আশায়, তারাও প্রত্যাশিত পাল্টা অভিযান শুরু করতে পারলো না বাস্তব নানা অসুবিধার ফলে। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র যা পাওয়া গেল তা প্রয়োজন ও প্রত্যাশার তুলনায় নিত্যন্ত কম। তদুপরি দেশের ভিতর থেকে দখলদার সেনাবাহিনীর ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির সংবাদে মনোবল বজায় রাখা ছিল সত্যই কঠিন। তবু মে-জুনের এই হতাশার আবহাওয়ার মাঝেই ট্রেনিং কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত প্রস্তুতি।