আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাধিত অগ্রগতিও নগণ্য ছিল না। ২৫শে মার্চের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মোট ২৪৭টি ছোট-বড় রেলওয়ে ব্রীজের মধ্যে ১৯৪টি ব্রীজের মেরামত সম্পন্ন হওয়ায় ৩রা জানুয়ারী নাগাদ তেইশটি সেকশনে রেল সার্ভিস পুনরায় চালু হয়; যদিও বড় ব্রীজগুলির মেরামত সম্পন্ন হওয়ার জন্য আরও ছ’মাসের মত সময়ের প্রয়োজন বলে সরকারী সূত্রে প্রকাশ করা হয়। একই সূত্র থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মোট ৩১৮টি সড়ক ব্রীজ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অস্থায়ী সংযোগ ও বিকল্প পথের সাহায্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা উত্তরবঙ্গে সড়ক যোগাযোগ মোটামুটিভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের সব কটি জেলার মধ্যে ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় ৩রা জানুয়ারী থেকে।
প্রায় ন’মাস দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর মন্ত্রিসভা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, পূর্বতন অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র থেকে সর্বাংশে বিচ্ছিন্ন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করার ক্ষেত্রে এবং একই সঙ্গে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মৌলিক সংস্কার সাধনের জন্য যে সমুদয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে বাস্তব সাফল্য সূচিত হয়-তদ্রূপ দৃষ্টান্ত নিতান্তই বিরল। তৎসত্ত্বেও এই সব উদ্যোগ জনমানসে প্রত্যাশিত উদ্দীপনা সৃষ্টিতে অসফল হয়। এর কারণ ছিল একাধিক। প্রথমত, পাকিস্তানী অত্যাচার ও দখল অবসানের পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের পুনর্বাসন ও জীবিকার সমস্যায় এতবেশী ভারাক্রান্ত ছিল যে অন্য কোন বিষয়ের প্রতি তাদের দৃকপাত করার সময় ছিল না। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রভাবশালী-সম্ভবত বৃহত্তর অংশই ছিলেন বহুদলীয় ঐক্যভিত্তিক আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার মৌল রূপান্তর কর্মসূচীর বিপক্ষে-পন্থা ও লক্ষ্য উভয় সম্পর্কেই এদের আপত্তি ছিল সুগভীর। তা ছাড়া নবাৰ্জিত রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর গোষ্ঠী ও দলগত ক্ষমতা বিস্তারের পক্ষে এদের ইচ্ছা এতই প্রবল ছিল যে, তাজউদ্দিনের প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার নীতি রদ করার জন্য এদের বিরুদ্ধতা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা তো বটেই দেশের সাধারণ মানুষ উদগ্রীব হয়ে ছিল শেখ মুজিবের প্রত্যাসন্ন মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতিক্ষায়। অংশত এই কারণেও অনেকের কাছে তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভার এই সব পদক্ষেপের মূল্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার অধিক কিছু ছিল না। অথচ তাজউদ্দিন অবিচল নিষ্ঠায় ১৯৭০ সালে প্রদত্ত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাষ্ট্রীয় নীতি ও সরকারী কার্যক্রম প্রণয়ন করে চলেন। একই সঙ্গে সরকারের কতিপয় আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পন্থা হিসাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কাঠামো সদ্ব্যবহারে উদ্যোগী হন।
ওদিকে ভুট্টো পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্নকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার উপাদান হিসাবে ব্যবহার করার কাজে উদ্যোগী হলেও তিনি এবং তার পাশ্চাত্য পৃষ্ঠপোষকগণ অচিরেই এই উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেন। ৩রা জানুয়ারী করাচীতে আহুত এক বিশাল জনসভায় প্রেসিডেন্ট ভুট্টো উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি যদি শেখ মুজিবকে ‘শর্তহীনভাবে মুক্তি দেন, তবে তারা তা অনুমোদন করবে কি না। সমবেত জনতা সমস্বরে তা সমর্থন করে। ৮ই জানুয়ারী রাওয়ালপিন্ডির বিমানবন্দরে ভোর তিনটায় ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিদায় জ্ঞাপন করেন। ঐ দিন সকালে শেখ মুজিব লন্ডনে পৌঁছান।
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রায় এক পক্ষকাল ধরে ভুট্টো মার্কিন অভিপ্রায় অনুযায়ী বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাখার যত চেষ্টাই চালিয়ে থাকুন, লন্ডনে পৌঁছানোর পর শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি নিজের সমর্থন ঘোষণা করেন। লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে আলোচনা এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লীতে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা লাভের পর ১০ জানুয়ারী ঢাকায় পৌঁছেই রেসকোর্সের হর্ষোৎফুল বিশাল জনসমুদ্রের সম্মুখে শেখ মুজিব ভুট্টোকে উদ্দেশ করে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিবর্তনীয়, পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বতন সম্পর্ক আর পুনঃপ্রতিষ্ঠার নয়।
এরপর মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব পুনর্নির্ধারণের। ১১ই জানুয়ারী সকালে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন প্রথম এ বিষয়ে একান্ত আলাপে প্রবৃত্ত হন। এতদিন শেখ মুজিব ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী। পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কোন কার্যকরী ক্ষমতা নেই। সরকার পরিচালনার সর্বপ্রধান ভূমিকা শেখ মুজিব পালন করেন, তা-ই ছিল অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের ঐকান্তিক কামনা। তাদের এই ইচ্ছার কথা উভয় নেতাই অবগত ছিলেন। কাজেই সরকার পরিচালনার মূল দায়িত্ব শেখ মুজিবের কাছে হস্তান্তরিত করার বিষয়টি স্বল্প আলোচনার মাধ্যমেই স্থির হয়। অবশ্য আলোচনার শুরুতে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেন। তাজউদ্দিন তখন জানান, পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগের বাইশ বৎসরের দাবী সহসা বাতিল করে প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়; কাজেই এদেশে পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে হবে এবং সে গড়ে তোলার দায়িত্ব শেখ মুজিবকেই পালন করতে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, ১৯৭০ সালে দেশবাসী বিপুল ভোটে সে রায়ই জ্ঞাপন করেছিল; মাঝখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করার পর দেশের সেই দুর্যোগকালে রাজনৈতিক কর্তব্যবোধ থেকে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন মাত্র।