সমস্যা প্রধানত ছিল, স্বঘোষিত ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। এরা না ছিল রাজাকারদের মত পলায়নপর বা চিহ্নিত, না ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মত তালিকাভুক্ত। তবু এদের জন্য জাতীয় মিলিশিয়াতে যোগদানের সুযোগ যদি উন্মুক্ত করা হয় তবে তাদের একাংশকে, সম্ভবত বৃহত্তর অংশকেই, জাতি গঠনের নবীন উদ্দীপনার মাঝে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা সম্ভব হবে-এই অনুমানের ভিত্তিতে সরকার সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। স্থির করা হয়, পূর্ণ রাজনৈতিক আস্থা সৃষ্টিকল্পে সকল দল, মত ও গ্রুপ নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে ‘জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠন, সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সংগঠন থেকে শুরু করে নিম্নতম ইউনিট পর্যন্ত বহুদলীয় কমান্ড গঠন, এই কমান্ডের অধীনে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি কর্তৃক গৃহীত জাতীয় পুনর্গঠন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ‘জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীর নিয়োগ এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি, তাদের পেশাগত বিকাশের সুযোগ, সামাজিক সম্মান, সুশৃঙ্খল বিকাশের জন্য পেশাগত নেতৃত্বকাঠামো ও অস্ত্রাগার প্রতিষ্ঠা-ইত্যাকার উপাদান ও আয়োজনের সমন্বয়ে জাতির স্বাধীনতা অর্জনকারী যুবশক্তিকে এক নতুন সমাজ গঠনের পুরোভাগে সংহত করা এবং এই উপায়ে জাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করা সম্ভব।
জাতীয় মিলিশিয়ায় যোগদানের ক্ষেত্রে ‘মুজিব বাহিনী’র সম্ভাব্য বিরোধিতা দূর করার জন্য যে দিন মিলিশিয়া স্কীম ঘোষণা করা হয়, সে দিনই অর্থাৎ ২৬শে ডিসেম্বর মেজর জেনারেল ওবানকে ঢাকা আনানো হয়। ‘মুজিব বাহিনী’র ভূমিকা যাতে নতুন স্বাধীনতার জন্য সহনীয় হয়, তদুদ্দেশ্যে বিলম্বে হলেও ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতার নিদর্শন তখন স্পষ্ট। ইতিপূর্বে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মণি গ্রুপের অগ্রাভিযানের পথ নির্ধারিত হওয়ায় ঢাকা পৌঁছাতে তাদের কিছু বিলম্ব হয় বটে। ততদিনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। ওবান ঢাকা পৌঁছানোর পর শেখ মণি এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন, অতঃপর ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কোন স্বতন্ত্র বাহিনীর অস্তিত্ব থাকবে না। ২রা জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার যখন জাতীয় মিলিশিয়ার ১১ জন সদস্যের সমবায়ে জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠন করেন, তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হলেও মুজিব বাহিনী’র দু’জন সদস্যকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই দিনে প্রকাশ করা হয় যে ইতিমধ্যেই প্রত্যেক জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের জরুরীভিত্তিতে জাতীয় মিলিশিয়া শিবির স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে সর্বদলীয় কমান্ডকাঠামো গঠিত হতে শুরু করে। এই স্কীম বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মেজর জেনারেল বি. এন. সরকারকে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
আওয়ামী লীগের ভিতরে যে উপদলীয় উত্তেজনা বিরাজমান ছিল, তার কিছু উপশম ঘটে ২৭শে ডিসেম্বর পাঁচজন নতুন মন্ত্রী নিয়োগের পর। এরা ছিলেন: আবদুস সামাদ আজাদ, ফণিভূষণ মজুমদার, জহুর আহমদ চৌধুরী, ইউসুফ আলী এবং শেখ আবদুল আজিজ। এদিকে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খোন্দকার মোশতাক দেশ মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথাসম্ভব সঠিক বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করেন।৬১ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ রক্ষা করতে পারেননি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যাতে মন্ত্রিসভায় কোন বিভেদের ছাপ না পড়ে তজ্জন্য অবশ্য খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রী পদে বহাল রাখা হয়। ইতিপূর্বে ২১শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার আবুল ফতেহকে মাহবুব আলম চাষীর কাছ থেকে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-সমর্থক দলগুলির মধ্যে ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে অতিশয় অধৈর্য হয়ে পড়লেও তাজউদ্দিন ‘৭০-এর নির্বাচনী রায় অনুযায়ী মন্ত্রিসভার দলীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখার প্রশ্নে অটল থাকেন। কিন্তু সেই সঙ্গে জাতীয় পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি অন্যান্য দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের কাঠামো সুদৃঢ় করে তুলতে শুরু করেন।
অংশত বাংলাদেশ সরকারের এই সব সঠিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে, অংশত ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন ও নিরপেক্ষ দৃঢ়তার ফলে এবং সর্বোপরি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাবার জন্য সাধারণ মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ফলে মন্ত্রিসভা ঢাকা প্রত্যাবর্তনের মাত্র সপ্তাহকালের মধ্যেই ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশে পরিস্থিতির বিস্ময়কর উন্নতি ঘটে। শহরাঞ্চলে লুঠতরাজ, অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং হিংসাত্মক ঘটনার দ্রুত অবসান ঘটতে শুরু করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্র শাসনের একটি সাধারণ ও সুপ্রাচীন নীতির যথার্থতা প্রমাণিত হয়-আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যদি নিরপেক্ষ দৃঢ়তায় আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম ও সতর্ক থাকে এবং তাদের কাজ যদি ঊধ্বর্তন হস্তক্ষেপে বিঘ্নিত না হয়, তবে সমাজ যত বড় অস্থিরতার মাঝেই নিক্ষিপ্ত হোক, তা পুনরায় বসবাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব।