এ কথা সত্য যে মুক্তিসংগ্রামের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ফলে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের নির্মীয়মাণ একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কজা থেকেই কেবল বেরিয়ে আসেনি, মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা পাকিস্তানী শাসনের সমর্থক বাঙালী বিত্তশালী ও সচ্ছল শ্ৰেণীকেও দুর্বল করে ফেলে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কায়েমী স্বার্থের এই অনুপস্থিতি/দুর্বলতার প্রশ্ন ছাড়াও এই শ্রেণীর সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক হিসাবে বিবেচিত আমলাতন্ত্রের পুঁজিবাদ-তোষণকারী ও দুর্নীতিপরায়ণ অংশের ক্ষমতা ও প্রভাব ছিল দুর্বল এবং সশস্ত্রবাহিনীর আয়তন ও ক্ষমতা ছিল সীমিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের উঠতি পুঁজিপতি ও বিত্তাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্তদের প্রভাব প্রবল হলেও, এই দলের মধ্য ও নিম্ন স্তরে, বিশেষত তরুণ অংশের মধ্যে, পুঁজিবাদী বিকাশের বিরুদ্ধবাদী অংশ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দক্ষিণপন্থী অংশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ব্যবধান এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন দেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের জন্য আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করা বিশেষ দুরূহ ছিল না। এক্ষেত্রে বরং অপেক্ষাকৃত জটিল সমস্যা ছিল, ভাল ও মন্দের সংমিশ্রণে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক শোষণহীন আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন কর্মসূচীর পিছনে ঐক্যবদ্ধ করা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ বহুদলীয় কমান্ডব্যবস্থার অধীনে এদের সৃজনশীল কর্মোদ্যমকে উৎসাহিত ও ব্যবহৃত করার।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের দুরূহ কাজটি সম্পন্ন হতে পারত, একমাত্র মার্কিন সাহায্যের প্রভাব ও সমর্থনেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য সম্পদের বিশাল প্রয়োজন মার্কিন পণ্য ও অর্থ সাহায্যে বহুলাংশে সহজ হতে পারত। এই মার্কিন সাহায্যের কাঁধে ভর করে পুঁজিবাদী অথনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজ যাতে কেউ শুরু করতে না পারে, সেই সচেতনতা থেকে ১৯শে ডিসেম্বর বেতার বক্তৃতায় তাজউদ্দিন ঘোষণা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য মার্কিন সাহায্য গ্রহণে আগ্রহী নয়। ২২শে ডিসেম্বর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দরে এবং ২৩শে ডিসেম্বর ঢাকা সচিবালয়ের সমস্ত অফিসার ও কর্মচারীদের সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা–এই তিন মূল নীতির উপর ভিত্তি করে দেশকে গড়ে তোলা হবে। সচিবালয়ের বক্তৃতায় সরকারী প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা সংগ্রাম করেছিলেন আইনের শাসন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সকল ধরনের শোষণ ও বৈষম্য চিরতরে বন্ধ করার জন্য এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এদেশের সকল মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব।
তাজউদ্দিনের এই সকল ঘোষণা প্রায় সর্বাংশেই ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় ঘোষণাপত্রের অধীন। দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌল রূপান্তরের জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ যে সব লক্ষ্য অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়, সে সম্পর্কে দলীয় নেতৃবৃন্দের প্রভাবশালী একাংশের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। ‘৭০-এর নির্বাচনে জনসাধারণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করার পর সেগুলির বাস্তবায়ন ছিল স্বাধীন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দলীয় নেতৃবৃন্দের দক্ষিণপন্থী অংশের সহযোগিতা যে সামান্যই পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে তাজউদ্দিনের কোন সংশয় ছিল না। কাজেই তিনি এই সব লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসাবে স্বাধীনতাসমর্থক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যবোধকে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে সংহত ও সক্রিয় করা এবং দেশের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর শক্তিতে রূপান্তরিত করার সংকল্প প্রকাশ করেন। ইতিপূর্বে ১৮ই ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা গণবাহিনীর সকল সদস্যের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে ঐ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর ২৩শে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঘোষণায় বলা হয়: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করেন যে মুক্তিবাহিনী এদেশের মেধার বৃহত্তম আধার, যার মধ্য থেকে এদেশের দ্রুত পুনর্গঠন এবং অবকাঠামো পুনঃস্থাপনের জন্য উৎসর্গিত নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের এ সঠিক ঘোষণার পাশাপাশি, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল অনিয়মিত অস্ত্রধারীর কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার করাও ছিল এ স্কীমের অন্যতম প্রধান অঘোষিত লক্ষ্য।
অস্ত্র তখন ছিল মূলত তিন ধরনের লোকের হাতে: (১) পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন আধা-সামরিক বাহিনী ও অসামরিক সমর্থক; (২) মুক্তিযোদ্ধা; এবং (৩) বিজয়কালীন স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এদের মধ্যে প্রথম গ্রুপের কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার অপেক্ষাকৃত সহজ প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানী সমর্থকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেরাই অস্ত্র ফেলে দিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। যে সব জায়গায় এরা প্রতিরোধ কেন্দ্র গড়ে তোলে সেখান থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে মনে হয় এবং অস্ত্রধারী পলাতকদের সাধারণ মানুষ চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে বাকী অস্ত্রশস্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজ এগিয়ে চলে। দ্বিতীয় গ্রুপ অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা ভারতের ট্রেনিং শিবির থেকে এসেছিল তারা এবং তাদের জন্য সরবরাহকৃত অস্ত্র ছিল তালিকাভুক্ত। দেশের ভিতরে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের জন্য সরবরাহকৃত অস্ত্র এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে তাদের পরিচয়, তাদের অধীনস্থ সদস্য সংখ্যা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। অগণিত মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংগ্রামী চরিত্রের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এক সফল মুক্তিযুদ্ধের অভিন্ন গৌরবদীপ্ত পটভূমিতে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার যে সম্ভাবনা ছিল তার জন্য সঠিক রাজনৈতিক আবহাওয়া ও সাংগঠনিক কাঠামো সৃষ্টির পরিকল্পনা প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হয়।