এই সংবাদ পাওয়ার পর নিউইয়র্কে অবস্থানরত ভুট্টো ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে স্বল্পকালের জন্য সাক্ষাৎ করেন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রের বিবৃতি অনুসারে নিক্সন ‘উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি’ সেই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বলে ভুট্টোর কাছে উল্লেখ করেন। ‘উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা’ প্রসঙ্গে নিক্সন ভুট্টোকে নির্দিষ্টভাবে কি পরামর্শ দিয়েছিলেন তা অজ্ঞাত থাকলেও, ওয়াশিংটন থেকে পাকিস্তান ফিরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর পরই ভুট্টো ২০শে ডিসেম্বর তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় ‘পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে ঘোষণা করেন, সেখানকার জনগণ যে পাকিস্তানের অংশ হিসাবে বসবাস করতে চায় তার এই বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন, এবং সর্বোপরি ঘোষণা করেন ‘অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে–বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও ভারতের সৈন্যের উপস্থিতি ব্যতিরেকে–আলাপ-আলোচনাভিত্তিক সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি প্রস্তুত রয়েছেন। ২১শে ডিসেম্বর ভুট্টো ঘোষণা করেন, শেখ মুজিবকে শীঘ্রই জেল থেকে মুক্তি দিয়ে অন্য কোথাও গৃহবন্দী করা হবে। ২২শে ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে ঘোষণা করা হয়, কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করা হয়েছে। ২৩শে ডিসেম্বর সংবাদ পাওয়া যায় তাঁকে আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডি আনা হয়েছে। ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরদিনই। ভুট্টোর এই অসাধারণ গতিবেগ তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়ের অসাধারণ গুরুত্বকেই প্রতিফলিত করে মাত্র।
২০শে ডিসেম্বর ‘অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য মিলিত হতে রাজী আছেন এই মর্মে ভুট্টোর ঘোষণা এবং শেখ মুজিবের আসন্ন মুক্তির সংবাদ স্বভাবতই বাংলাদেশের স্বাধীন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি করে। লন্ডনের টাইমস্ পত্রিকার প্রতিনিধি কর্তৃক এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তাজউদ্দিন স্পষ্ট ভাষায় জানান, কোন শিথিল ফেডারেশনের অধীনে, ‘অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিবের সহায়তা পাওয়া যাবে এর চাইতে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না এবং দৃঢ়তার সঙ্গেই তিনি ঘোষণা করেন, যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা আর কিছুতেই পরিবর্তনীয় নয়। পশ্চিমা দেশগুলির চোখে তাজউদ্দিন স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন সব চাইতে আপোসহীন; কাজেই ১৪ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব জানানোর পর এবং নিক্সনের ‘গানবোট কূটনীতি’ বঙ্গোপসাগরের চরাভূমিতে আটকে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পশ্চিমা ইউরোপীয় মহলে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে যে, পাকিস্তানের সামরিক আধিপত্য বিলুপ্ত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে এর ‘ভবিষ্যৎ সম্পর্ক’ নিরূপণের জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে যে আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন, সেখানে তাজউদ্দিনের পরিবর্তে শেখ মুজিবকে অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে যে ক’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ছিল তন্মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্ন। বাংলাদেশ সরকার বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দী আটকের পর এক জোরাল অবস্থান থেকেই সে আলোচনা চালাতে পারতেন। কিন্তু তার আগেই ক্ষমতাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো শেখ মুজিবের বন্দিত্বের সুযোগ নিয়ে সরাসরি তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ইত্যবসরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দু’দিনে সপ্তম নৌবহরের ব্যর্থতা পরিদৃষ্টে ক্রুদ্ধ কিসিঞ্জার যখন নির্মীয়মাণ রুশ-মার্কিন সম্পর্ককাঠামোর ক্ষতিসাধনের হুমকি দেন, তখন এই বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়া হিসাবে মার্কিন বৈদেশিক নীতির বিষয়ে সেক্রেটারী রজার্স ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ফলে উপমহাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গিগত অনৈক্য বহুলাংশে হ্রাস পায়। ২৩শে ডিসেম্বর সেক্রেটারী অব স্টেট রজার্স উপমহাদেশ-সংক্রান্ত তাঁদের নীতির সংশোধন করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়, তবে তাঁরা এই ‘দুই অংশের’ বিচ্ছিন্নতারও পক্ষপাতী নন। বিগত নয় মাসের ঘটনা সম্পর্কে বহুলাংশেই অনবহিত বন্দী শেখ মুজিবের সঙ্গে ভুট্টো যে দিন আলাপ-আলোচনা করতে চলেছেন, ঠিক সে দিনই রজার্সের এই বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।
‘পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ’, ‘দেশের দুই অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য নয়’-এ জাতীয় বিবৃতির উদ্দেশ্যে স্পষ্টতই ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে কোন না কোনভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কিত রাখার চেষ্টা করা। ভুট্টোও, জানা যায়, একই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সব প্রচেষ্টার পিছনে সম্ভবত একটি মুখ্য বিবেচনা সক্রিয় ছিল: সব। সাফল্যের পরেও ভারত (এবং পরোক্ষভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন) যে উপমহাদেশের ঘটনাধারা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত শক্তি নয় তা প্রমাণ করা। তৎসত্ত্বেও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুট্টোর সম্ভবত বৃহত্তর স্বার্থ নিহিত ছিল পাকিস্তানের এই দুই অঞ্চলের ক্ষমতার বিচ্ছেদ স্থায়ী করার মধ্যে। ভুট্টোর জন্য এই উপলব্ধি নিশ্চয়ই নতুন ছিল না যে, একমাত্র পূর্ব ও পশ্চিমের স্থায়ী বিচ্ছেদের মাধ্যমেই পশ্চিম পাকিস্তানে তার ক্ষমতার আসনকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু এ বিষয়ে অশোভন ব্যগ্রতা প্রকাশের রাজনৈতিক সুযোগ ছিল সীমিত। কাজেই বাহ্যত হলেও ভুট্টোকে এই সময় পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে সংযোগসূত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত দেখা যায়। মূলত এই উদ্যোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই দ্বিতীয় স্তরের প্রচেষ্টা–সপ্তম নৌবহর দ্বারা পাকিস্তানকে একত্রিত রাখায় প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরের। শেষ পর্যন্ত যদি এ প্রচেষ্টাও সফল না হয় এবং ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অপরিবর্তিতই থাকে, তবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সূচিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সম্ভাব্য মৌল রূপান্তর রদ করার জন্য এই দেশকে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনস্থ করার উদ্যোগই সম্ভবত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় স্তরের প্রচেষ্টা। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দারিদ্র্য-প্রপীড়িত দেশের মত বাংলাদেশকে মার্কিনী উদ্ধৃত্ত খাদ্য, পণ্য ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে পশ্চিমা প্রভাব বলয়ের অধীনস্থ করার চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অভিনব ছিল না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যদি শেষ পর্যন্ত সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সেই অবস্থায় পণ্য ও অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে এই নতুন দেশকে মার্কিনী প্রভাব বলয়ের অধীনস্থ করার প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা বস্তুত শুরু হয় বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করারও আগে।