দেশ শত্রুমুক্ত এবং জাতীয় সরকার স্বদেশে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রকে সচল ও সংগঠিত করার মুহূর্তে প্রধানতম অনায়ত্ত লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবের মুক্তি। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য তখন আগ্রহে অধীর। ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রিতে প্রত্যাসন্ন আঘাতের মুখে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের চোখে তিনিই ছিলেন মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা; ১৯৬৬ সালে ৬-দফা কর্মসূচী ঘোষণার ফলে কারারুদ্ধ হওয়ার পর ১৯৬৮-৬৯ সালের ছাত্র-জনতার ৬-দফা/১১-দফা দাবীর প্রমত্ত আন্দোলনের মুখে মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিব যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে। ১৯৬৮-৬৯ এবং ১৯৭১ এই দুই যুগান্তকারী সংগ্রামের কোনটিতেই তিনি নিজে যোগ দিতে পারেননি, কেবল সংগ্রামের ডাক দেবার অভিযোগে দু’বারই তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও, এর মাঝখানে ১৯৭০-এর নির্বাচনকে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির গণভোটে রূপান্তরিত করে সমগ্র দেশকে তিনি যেভাবে এক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংহত করেন, যেভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির দাবীর বৈধতা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলেন এবং যেভাবে ১লা মার্চ থেকে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভকে এক দুর্বার অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত করে মানুষের সংগ্রামী চেতনায় মৌল রূপান্তর সাধন করেন–তার ফলে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতা হিসাবে সাধারণ গণমানসে তিনি সর্বোচ্চ আসন অধিকার করেন। ২৫শে মার্চের পর ইয়াহিয়ার হত্যাউন্মত্ত সৈনিকেরা যখন এদেশের মানুষকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণে বাধ্য করে, তখন সংগ্রামের লক্ষ্য ও পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মনে তার সেই আসন অপরিবর্তিত থাকে; সাধারণ মানুষ হত্যা ও বিভীষিকার মাঝে শেখ মুজিবকেই মনে করেছে তাদের মুক্তিআকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তার এই প্রতীক মূল্য যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, তজ্জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠার প্রচার করেছে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ’, প্রচার করেছে তাকে নিয়ে রচিত অজস্র কথা, গাথা ও গান।
অবশেষে এই বাস্তব ও কল্পনার মিলিত উপাদানে গঠিত সেই অপরাজেয় নায়ককে পাকিস্তানী বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার পালা। তার মুক্তির পণমূল্য হিসাবে সাড়ে একানব্বই হাজার পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক বন্দী তখন বাংলাদেশের করায়ত্ত। মুখ্যত শেখ মুজিবের মুক্তির পণমূল্য হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশের অবরুদ্ধ উপকূলভাগ দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর নিষ্ক্রমণ পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। যদি উপকূলভাগ দিয়ে তাদের পলায়নপথ উন্মুক্ত রাখা হত, তবে ৭ই ডিসেম্বর যশোরে তাদের পতনের পর দক্ষিণ দিকে তাদের যেভাবে দৌড় শুরু হয়েছিল তার ফলে সম্ভবত পরবর্তী দু’তিন দিনের মধ্যেই সমগ্র বাংলাদেশ খালি করে সমুদ্রপথে তারা পালিয়ে যেত; ফলে ৯ই ডিসেম্বরে যুদ্ধবিরতির ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মালেকের আবেদন, ইয়াহিয়ার সম্মতি এবং তার পরের দিন রাও ফরমান কর্তৃক সসম্মানে সৈন্য প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সহায়তা প্রার্থনা–এই সব কোন কিছুর প্রয়োজন হয়ত তাদের হত না। পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে, পাকিস্তানের জন্য নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সমর্থন যত প্রবলই হোক, তারপর বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর কোন সামরিক ভিত্তিই তাঁকে দেখতে পেতেন না। কাজেই সর্বাধিক সংখ্যক যুদ্ধবন্দী পাবার আশায় পাকিস্তানী বাহিনীর পলায়নপথকে রুদ্ধ করে কার্যত সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়; ফলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, প্রাণহানি বাড়ে, বিশ্বের বৃহত্তম দুই শক্তির সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। সপ্তম নৌবহর এসে পড়ার প্রাক্কালে দৈবাৎ পাকিস্তানী সিগন্যালস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকায় গভর্নর ভবনের উপর ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভ্রান্ত আক্রমণে এবং স্থল বাহিনীর ক্রম সঙ্কুচিত বেষ্টনীর মুখে পাকিস্তানী কমান্ডের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ায় বাংলাদেশের বিজয় সম্পন্ন হয়। কাজেই এক অসামান্য ঝুঁকি নিয়ে শেখ মুজিবের এই মুক্তিপণ সংগৃহীত হয়। কিন্তু তা সদ্ব্যবহারের জন্য কোন উদ্যোগ নেওয়ার আগেই জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ২১শে ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে স্পষ্ট আভাস দেওয়া হয়, শেখ মুজিবকে শীঘ্রই মুক্তি দেওয়া হবে।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে তাদের নির্বুদ্ধিতার মাশুল দিতে হয় নিয়াজীর আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরেই। বৈদেশিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্থিতাবস্থা কায়েম করার কৌশল হিসাবে ইয়াহিয়াচক্র ৩রা ডিসেম্বর থেকে সীমিত যুদ্ধ শুরু করেছিল। তার পরিণাম ফল হিসাবে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান তো বটেই, তদুপরি তাদেরকে ৯১,৪৯৮ জন অভিজ্ঞ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকেও যে যুদ্ধবন্দী হিসাবে হারাতে হবে, তা ছিল ইয়াহিয়াচক্রের চিন্তার অগম্য। ১৬ই ডিসেম্বরে সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া চূড়ান্ত বিজয় অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প’ প্রকাশ করা সত্ত্বেও পরদিন পাকিস্তানের সর্বত্র গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে। ঐ দিন ভুট্টোর সামপ্রতিক চীন সফরের দুই সঙ্গী সামরিক বাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান-সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষোভকে মূলধন করে ইয়াহিয়াচক্রের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা প্রতিহত করেন (ফলে ভারতের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হয়) এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানানোর পক্ষে সিদ্ধান্ত গঠন করেন।