ঐ দিন সন্ধ্যায় ঢাকার প্রথম গণজমায়েতে মুক্তিযোদ্ধাদের কতিপয় নেতা শান্তি ও শৃঙ্খলার আবেদন জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করার পর হঠাৎ কি আবেগবশত বিদেশী সাংবাদিক ও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অজ্ঞাত অভিযোগে ধৃত চারজন বন্দীকে আধ ঘণ্টাকাল ধরে পিটিয়ে অবশেষে বেয়োনেটবিদ্ধ করে হত্যা করে। স্থলভূমির মুক্তিযুদ্ধে নিঃসন্দেহে সর্বাপেক্ষা সফল অধিনায়ক টাঙ্গাইলের আবদুল কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক নিজ হাতে এদের বেয়োনেটবিদ্ধ করার সচিত্র সংবাদ সারা বিশ্বে ফলাও করে প্রচারিত হয়। বুদ্ধিজীবীদের শবদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার পর সারা শহরে যখন প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তখন সেই অবস্থায় কাদের সিদ্দিকীর এই দৃষ্টান্ত ভয়াবহ রক্তপাতের সূচনা করতে পারে এই আশঙ্কায় ভারতীয় বাহিনী কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করার উদ্যোগ নেয়। বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার অধিনায়ক এবং যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব ও জনপ্রিয়তার অধিকারী কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করার উদ্যোগ ভারতীয় বাহিনীর জন্য সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। তা ছাড়া ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানী সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির খবর আসছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের সূত্রপাত হয় যখন দৃশ্যত কিছু শিখ অফিসার এবং তাদের অধীনস্থ সেনা যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মূলত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এবং খুলনার ক্যান্টনমেন্ট ও শিল্প এলাকায় লুঠপাট শুরু করে; কিন্তু তা ব্যাপক আকার ধারণ করার আগেই তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃঢ় হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে যায়। এই সব ঘটনার ফলে ভারতীয় বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান, আরও ৩/৪ দিনের আগে ঢাকার ন্যূনতম শৃঙ্খলা আনয়ন করা সম্ভব নয়।
মন্ত্রিসভার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে ঢাকায় ন্যূনতম নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠা করা ভারতীয় বাহিনীর মূল উৎকণ্ঠা হলেও, মন্ত্রিসভার প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব ঘটার প্রধান কারণটি ছিল অন্য। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল পরিকল্পনা ও কর্মসূচী প্রণয়ন করেন ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর বিপর্যস্ত অবস্থা এবং পাকিস্তানভিত্তিক অর্থনৈতিক সত্তা থেকে সহসা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অর্থ ও সম্পদের চূড়ান্ত অভাবের দরুন উক্ত পরিকল্পনা ও কর্মসূচী অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করা কার্যত অসম্ভব ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করার মত সম্পদ ও কারিগরি সহায়তার বাস্তব আয়োজন ব্যতীত কেবল মন্ত্রিসভার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ সরকার কার্যকরভাবে সক্রিয় হতে পারতেন না। দ্বিতীয়ত, যে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের এই যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়, সেই এক কোটি শরণার্থীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার নির্দিষ্ট আয়োজন না করে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের জন্য মন্ত্রিসভার ব্যগ্রতা প্রকাশ সঠিক বা শোভনীয় কোনটাই হত না।
যুদ্ধ শুরু হবার পর উপরোক্ত বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার পূর্ণ সুযোগ ছিল না। বিশেষত, বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিষয়ে সমস্ত কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত ভারতের প্রধান কর্মকর্তা ডি. পি. ধর সপ্তম নৌবহর উদ্ভূত জরুরী পরিস্থিতির জন্য ১১ই ডিসেম্বর থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি অবধি মস্কোয় অবস্থান করছিলেন। ১৮ই ডিসেম্বরে ডি, পি. ধর কোলকাতা এসে পৌঁছাবার পর ২১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে তাঁর আলাপ আলোচনা চলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার অনুরোধ ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। সেই সময় ঢাকা ও দিল্লীর মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থা যা ছিল, তাতে দু’দেশের সরকারের পক্ষে এতগুলি জরুরী বিষয়ে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করা এবং বিচ্ছিন্ন ও বিপর্যস্ত অর্থনীতির জরুরী পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভারতীয় সহযোগিতার পরিসর নীতিগতভাবে স্বীকৃত হওয়ার পর স্থির হয়, বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট আয়োজন নিরূপণ করা এবং সরবরাহের কর্মসূচী প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে ২৩শে ডিসেম্বর এক উচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় প্রতিনিধিদল ঢাকা পৌঁছাবেন। এই সব ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার পর অবশেষে ২২শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভা জনতার কাছ থেকে বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন বটে, তথাপি এই বিলম্বের ফল রাজনৈতিকভাবে মন্ত্রিসভার জন্য শুভ হয়নি–বাংলাদেশের আগ্রহে উদ্বেলিত মানুষের মধ্যে নৈরাশ্যের ভাব সৃষ্টি হয় এবং মন্ত্রিসভা তীব্রভাবে সমালোচিত হন। কিন্তু ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর মন্ত্রিসভা দ্রুতগতিতে যে সব সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার ফলে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজন উপযোগী কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত অগ্রসর হয়, আভ্যন্তরীণ সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা হ্রাস পায়, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়, পরিত্যক্ত কলকারখানাসমূহ সচল করার জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করা হয় এবং সাধারণভাবে অর্থনৈতিক জীবন সচল হতে শুরু করে।