কিন্তু পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পর আইন ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সব চাইতে বড় বিপদ আশঙ্কা করা হয় পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনীসমূহের মধ্যে গোঁড়া ইউনিটগুলিকে নিয়ে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক মিশ্র উপাদানে গঠিত রাজাকার, সশস্ত্র জামাতে ইসলামীদের দ্বারা গঠিত আল-বদর এবং সশস্ত্র বিহারীদের আল শামস-এই তিন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৬০/৭০ হাজার। এ ছাড়া যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানীরা বিহারী ও জামাতে ইসলামী কর্মীদের মধ্যে অকাতরে অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে বলে জানা যায়। পাকিস্তানের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের অধিকাংশই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আত্মগোপন করার অথবা মফস্বল ও ভারত অভিমুখে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও এদের ধর্মান্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ অংশের পক্ষে কোন বেপরোয়া কাজই অসাধ্য ছিল না। পাকিস্তান সমর্থক গোঁড়া অংশকে চিহ্নিত করে তাদের নিবৃত্ত না করা পর্যন্ত ঢাকা শহরকে বিপদমুক্ত হিসাবে গণ্য করা অসম্ভব হত। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা বাদেই ইয়াহিয়া খান ‘পূর্ণ বিজয় লাভ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প’ ঘোষণা করায় এবং দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পূর্ণ শক্তিতে উপস্থিত থাকায়, নবতর যুদ্ধের আশঙ্কা তখনও সর্বাংশে তিরোহিত নয়।
এই পটভূমিতে ঢাকায় উপনীত ভারতীয় সামরিক কমান্ড শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিধানে তাদের সামরিক অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। এর ফলে এবং ভারত সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনে তিন অথবা চার দিন বাদে মন্ত্রিসভার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাব্য দিন স্থির করা হয়। তার আগে ঢাকায় ন্যূনতম প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারী জেনারেল রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের সচিবদের একটি দল ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকা এসে পৌঁছান। একই দিনে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও ঢাকা আসেন। ১৯শে ডিসেম্বর থেকে স্বল্প সংখ্যক অফিসার ও কর্মচারীদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারীয়েট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়।
ঢাকায় আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কত জটিল তা ১৭ই ডিসেম্বর থেকে ক্রমশ উন্মোচিত হতে শুরু করে। ১৬ই ডিসেম্বর রাত্রি থেকে বিজয়োল্লাসে মত্ত যে সব ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ১৭ই ডিসেম্বর দেখা যায় তাদের অনেকের হাতেই চীনা AK৪৭ রাইফেল ও স্টেন গান। এই সব অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার কোন প্রশ্ন ছিল না। বস্তুত এই সব অস্ত্রধারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কখনো মুক্তিযোদ্ধাও ছিল না-অন্তত মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ইউনিট নেতাই এদের সনাক্ত করতে পারেনি। জানা যায়, এতদিন যে সব তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে–এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সচ্ছল বা প্রভাবশালী অভিভাবকদের নিরাপদ আশ্রয়ে–বসবাস করছিল তারাও পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বিজয় উল্লাসে বিজয়ী পক্ষে যোগ দেয়। মুখ্যত এদের হাতেই ছিল পাকিস্তানী সৈন্য এবং সমর্থকদের ফেলে দেওয়া অস্ত্র অথবা অরক্ষিত পাকিস্তানী অস্ত্রাগার থেকে লুঠ করা অস্ত্রশস্ত্র এবং অঢেল গোলাগুলি। ১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পর এই বাহিনীর উৎপত্তি ঘটে বলেই অচিরেই ঢাকাবাসীর কাছে এরা ‘Sixteenth Division’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কালক্ষেপণ না করে এদেরই একটি অংশ অন্যের গাড়ী, বাড়ী, দোকানপাট, স্থাবর ও অস্থাবর বিষয়সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দখল করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। এদের পিছনে তাদের সৌভাগ্যান্বেষী অভিভাবক বা পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থন কতখানি ছিল বলা শক্ত, তবে ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত বিভাগ ও দাঙ্গার পর এই প্রক্রিয়াতেই অনেক বিষয়সম্পত্তির হাতবদল ঘটেছিল। সুযোগসন্ধানী ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’ সৃষ্ট এই ব্যাধি অচিরেই সংক্রমিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে। তারপর কে যে সিক্সটিনথ ডিভিশনের লোক, কে যে মুক্তিযোদ্ধা আর কে যে দলপরিবর্তনকারী রাজাকার–সব যেন একাকার হয়ে এমন এক লুঠপাটের রাজত্ব শুরু করে যে, ঢাকা শহরে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক জরুরী দায়িত্ব পালন ছাড়াও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানীদের স্থানীয় অনুচরদের বিরুদ্ধে স্বজন হারানো, লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত দেশবাসীর পুঞ্জীভূত ক্রোধ এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করা ছিল এক দুরূহ ব্যাপার। ভারতীয় সেনাবাহিনী রেডক্রসের অভয়াশ্রয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং পাক বাহিনী ও বিহারী-অধ্যুষিত অঞ্চলের চারদিকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলে ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটতে থাকে। দৃশ্যত মুক্তিযোদ্ধাদের ইউনিট কমান্ডারদের মধ্যে কারো কারো পক্ষে তাদের সহযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ করাও সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে। এহেন অবস্থার মাঝে ১৮ই ডিসেম্বর রায়ের বাজারে কাটাসুর নামক এক ইটখোলার খাদে হাতবাঁধা অবস্থায় দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীসহ প্রায় দুইশত ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ায় মানুষের ক্রোধ, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আবেগ চরমে পৌঁছায়।