এই সব অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানী প্রস্তাব প্রত্যাখান করে নিয়াজীর কাছে দাবী করেন, ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর শর্তহীন আত্মসমর্পণই যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একমাত্র ভিত্তি হতে পারে। মানেকশ’র এই দাবীর পিছনে যে শক্তি বিদ্যমান ছিল তা তখন সমগ্র রণাঙ্গনে প্রতিফলিত। ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দক্ষিণ, পূর্ব, পূর্ব-উত্তর ও উত্তর দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনী ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে সমবেত। সপ্তম নৌবহরের স্থল সংযোগ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য স্থান চট্টগ্রাম উপকূলভাগও তখন মিত্রবাহিনীদ্বয়ের করায়ত্ত হওয়ার পথে। সারাদিন ধরে ভারতীয় জঙ্গীবিমান ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানস্থল, বাঙ্কার, কমান্ড-কেন্দ্র, সামরিক উপদফতর প্রভৃতির উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে চলে।
আক্রমণের মুখে দখলদার সৈন্যরা নানা কৌশল অবলম্বন করে। কোন কোন পাকিস্তানী বাঙ্কারের উপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে ভারতীয় বিমান ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়; কেননা আত্মরক্ষার্থে পাকিস্তানীরা সেই সব বাঙ্কারের তাপদগ্ধ ছাদে হাত-পা বাধা অবস্থায় স্থানীয় জনসাধারণকে শায়িত রেখেছিল। সেনানিবাস থেকে অফিসাররা তাদের দফতর সরিয়ে নিয়েছিল অসামরিক এলাকার বিভিন্ন অংশে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষই যেখানে বিপক্ষে, সেখানে সরে গিয়েও তাদের পরিত্রাণ মেলেনি। তাদের নতুন আশ্রয়ের খবর সাথে সাথে আশেপাশের মানুষ জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের; মুক্তিযোদ্ধারা খবর পাঠিয়েছে নগরের উপকণ্ঠে ভারতীয় সিগন্যালসকে এবং তার কিছু পরেই ভারতের জঙ্গী ও বোমারু বিমান এই সব নতুন লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর লক্ষ্যভেদী, উপর্যুপরি আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কাজে ব্যতিব্যস্ত, সন্ত্রস্ত ও সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ড এমনিভাবে শর্তহীন আত্মসমর্পণের দিকে তাড়িত হয়। অবশেষে নিয়াজীর অনুরোধে ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। পরদিন সকালে বিমানাক্ৰমণ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলীর মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ছ’ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের একজন স্টাফ অফিসার পাঠানোর অনুরোধ জানান যাতে অস্ত্র সমর্পণের ব্যবস্থাদি স্থির করা সম্ভব হয়। এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগে অবশ্য মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকী বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর ব্রীজে হাজির হন এবং সেখান থেকে নাগরা নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার পর সকাল ১০:৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নাগরার বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যেকব মধ্যাহ্নে ঢাকা এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য ঢাকা প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ মুখরিত মানুষের ভিড়ে। বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার, এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকা অবতরণ করেন। এর আধ ঘণ্টা বাদে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল হর্ষোৎফুল জনতার উপস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সমরাধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী ‘বাংলাদেশে অবস্থিত’ সকল পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। কিছু পরেই ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনই সপ্তম নৌবহর প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণতম প্রান্তে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।
অধ্যায় ২২: ডিসেম্বর – জানুয়ারি
১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় যেদিন পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, ঠিক সেদিনই কোলকাতায় প্রবাসী সদর দফতর থেকে বাংলাদেশ সরকার সমগ্র দেশে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসকদের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী পাঠাতে শুরু করেন। শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তার জরুরী করণীয় নির্ধারণের জন্য ২২শে নভেম্বরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সচিবদের সমবায়ে যে সাবকমিটি গঠন করেছিলেন (পরিশিষ্ট ঠ-এ বর্ণিত), সেই সাবকমিটি এবং পরিকল্পনা সেল পাশাপাশি এ যাবত কাজ করে চলেন। ফলে বেসামরিক প্রশাসন এবং আইন ও শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনরুজ্জীবন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন, খাদ্য ও জ্বালানিসহ জরুরী পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়করণ, সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের পুনরুদ্ধার, জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে সচিব সাবকমিটি ও পরিকল্পনা সেলের সুপারিশসমূহ মন্ত্রিসভার বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য হাজির করা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রিসভার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পর জেলা পর্যায়ে জরুরী করণীয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে জেলা প্রশাসকের প্রতি নির্দেশপত্র প্রেরিত হয় ৭ই ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর থেকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে উনিশটি জেলার জন্য জেলা প্রশাসকদের মনোনয়ন ও নিয়োগ সম্পন্ন হয়। ১৭ই ডিসেম্বর ঐ সব জেলার সহকারী প্রশাসক পর্যায়ে নিয়োগ করা হয় আরো ছচল্লিশজন অফিসার।