১৪ই ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের কিছু আগে সংগৃহীত একটি পাকিস্তানী সিগন্যাল থেকে দিল্লীর বিমান সদর দফতর জানতে পারে, মাত্র ঘণ্টাখানেক বাদে ঢাকার গভর্নর ভবনে গভর্নরের মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তৎক্ষণাৎ ঐ বৈঠক চলাকালেই গভর্নর ভবন আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেরিত অর্ধ ডজন মিগ-২১ সঠিক সময়ে গভর্নর ভবনের উপর নির্ভুল রকেট আক্রমণ চালায়। মন্ত্রী পরিষদসহ গভর্নরের তাৎক্ষণিক পদত্যাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শেষ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিয়াজীর উপর ন্যস্ত হয়। গভর্নর ভবনের পরেও ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুসমূহের উপর ভারতীয় বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। সপারিষদ গভর্নর মালেকের পদত্যাগের সংবাদ এবং ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড থেকে ঘন ঘন প্রেরিত দুর্গত বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবশেষে ইয়াহিয়া খানের চৈতন্যোদয় হয়। বেলা আড়াইটার দিকে গভর্নর মালেক এবং ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি লে. জেনারেল নিয়াজীর কাছে ইয়াহিয়ার যে বার্তা এসে পৌঁছায় তাতে পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের সহযোগীদের জীবনরক্ষার জন্য যুদ্ধ বন্ধ করার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।
১৪ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের ভোর তিনটায় অর্থাৎ ঢাকায় ভারতীয় বিমানবাহিনী কর্তৃক গভর্নর ভবন আক্রমণের অন্তত দু’ঘণ্টা পরে সোভিয়েট সরকার নিক্সনের সর্বশেষ চরমপত্রের জবাবে জানান: উপমহাদেশ প্রশ্নে তাদের দুই সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট নিকটতর’ এবং ভারত সরকারের কাছ থেকেও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন ভূখণ্ড দখলের পরিকল্পনা তাদের নেই; কিন্তু পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের পরাজয় রোধের জন্য নিক্সনের চরমপত্রসমূহে বর্ণিত সর্বপ্রধান দাবী তথা ভারত কর্তৃক তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রশ্নে সোভিয়েট নোট সম্পূর্ণ নীরব থাকে। নীরব থাকার কারণও ছিল-সে দিনই সন্ধ্যা থেকে সোভিয়েট সংবাদমাধ্যমগুলি মুক্ত এলাকায় প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে।
এদিকে বিমান আক্রমণের ফলে ঢাকার ট্রান্সমিটার কয়েক দিন আগেই অচল হয়ে পড়েছিল। কাজেই ইয়াহিয়ার অনুমতি লাভের পর লে. জেনারেল নিয়াজী কয়েকটি শর্ত সম্বলিত যুদ্ধবিরতির এক প্রস্তাব ভারত সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য মার্কিন কন্সাল জেনারেল স্পিভাককে অনুরোধ জানায়। স্পিভাক বার্তাটি দিল্লী না পাঠিয়ে ওয়াশিংটনে পাঠান। যদিও যে কোন বার্তা তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে পাঠাবার মত ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল, তবু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ এই বার্তা-যা অবিলম্বে পৌঁছলে ঢাকায় বন্দী কিছু বুদ্ধিজীবীসহ অনেকের প্রাণ হয়তো রক্ষা পেত-সংশ্লিষ্ট প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে প্রায় একুশ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। এই অসাধারণ বিলম্ব থেকে অনুমান করা চলে, বার্তাবাহক মার্কিন প্রশাসন ‘পাকিস্তানকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করার’ সকল অবশিষ্ট সম্ভাবনা ইতিমধ্যে অন্বেষণ করেন। ইতিপূর্বে ইয়াহিয়ার পূর্ণ অনুমতি নিয়ে রাও ফরমান আলী ১০ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি, পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রস্তাব জাতিসংঘের কাছে পাঠিয়েছিল তা কেবলমাত্র মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপের ফলেই বাতিল হয়। সপ্তম নৌবহর তাদের সাহায্য করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে এই মর্মে নিশ্চয়তা লাভ করার পরেই আরও পাঁচ দিনের জন্য এ যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়। তারপর ১৪-১৫ই ডিসেম্বরের এই ২১ ঘণ্টার অধিকাংশ সময় ধরে অবশিষ্ট পন্থার অন্বেষণ ও পর্যালোচনার পর মার্কিন প্রশাসন সম্ভবত নিশ্চিত হন যে, শক্তির পরিবর্তিত ভারসাম্যের জন্য এই উপমহাদেশ তাদের প্রথাসিদ্ধ ‘গানবোট কূটনীতি’ প্রয়োগের উপযুক্ত স্থান নয়।
১৫ই ডিসেম্বর অপরাহ্নে নিয়াজীর যুদ্ধবিরতির বার্তা দিল্লীতে পৌঁছানোর পর দেখা যায়, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ এই প্রস্তাবের অন্তর্গত নয়। তার প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল, যুদ্ধবিরতির পর অস্ত্রশস্ত্র সমেত পাকিস্তানী বাহিনীর কোন পূর্ব নির্ধারিত স্থানে স্পষ্টতই দক্ষিণে উপকূলভাগে-জমায়েত হওয়ার পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা। এ ছাড়া, ১৯৪৭ সাল থেকে যে সব বহিরাগত পূর্ব বাংলায় বসবাস করে এসেছে। এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে যারা ১৯৭১-এর মার্চ থেকে পাকিস্তানী শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে তাদের যাতে কোন ক্ষতি না করা হয় তদ্মর্মে নিশ্চয়তা লাভের অনুরোধ নিয়াজীর বার্তায় জানানো হয়। মার্চে গণহত্যা শুরুর পর স্বেচ্ছায় যারা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, তাদের কৃতকর্মের গুরুত্ব নিরূপণ করে শাস্তি বিধানের অধিকার ছিল বাংলাদেশ সরকারের একার-কাজেই এ ব্যাপারে ভারতের কোন বক্তব্য ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত দক্ষিণের কোন মনোনীত স্থানে নির্বিঘ্নে জমায়েত হতে দেওয়ার প্রস্তাব এবং বাংলাদেশের উপকূলভাগ অভিমুখে সপ্তম নৌবহরের অগ্রগতির সংবাদ থেকে এই সন্দেহ প্রবল হয়ে ওঠে যে, মার্কিন নৌবহর অন্ততপক্ষে এই অবরুদ্ধ পাক সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করবে। উপকূলভাগে পৌঁছার পর সপ্তম নৌবহর কেবল পাকিস্তানীদের স্থানান্তরের মধ্যেই নিজেদের ভূমিকা আবদ্ধ রাখবে কি না সে নিশ্চয়তারও অভাব ছিল। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে নিয়াজীর প্রস্তাবে কোন উল্লেখ না থাকায়, এই সৈন্যবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছার পর যুদ্ধের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি কি দাঁড়াবে তা ছিল আর একটি বিচার্য বিষয়।