১৩ই ডিসেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশের স্থলবাহিনীর অভিযান ঢাকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে অগ্রসর। উত্তর দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী এবং কাদের সিদ্দিকী পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাগণ ঐ দিন সন্ধ্যায় পাক বাহিনীর হাল্কা প্রতিরোধ ব্যর্থ করে কালিয়াকৈর অবধি এসে পৌঁছায়। বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসাবে ২-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে মুরাপাড়ায় উপস্থিত হয় একই দিনে। ঢাকার পূর্ব দিকে ডেমরা ফেরীর দিকে অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী প্রতিরোধের সম্মুখীন। ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের মোকাবিলা করার মত ভারতীয় ট্যাঙ্ক তখনও মেঘনা অতিক্রমে অসমর্থ এবং তৎকারণে ঢাকা নগরীতে পাকিস্তানী প্রতিরোধের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত স্থল অভিযানের তখনও দেরী। সমুদ্রপথে পলায়নের সুযোগ লোপ পাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ফলে চূড়ান্ত লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসাবে ঢাকার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু সমগ্র আকাশ জুড়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র অধিকার, ঢাকায় পাকিস্তানী সামরিক অবস্থানের বিরুদ্ধে তাদের নির্ভুল ও তীব্রতর আক্রমণ রচনা, ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক পলায়ন উপযোগী সকল সমুদ্রযানের ধ্বংস সাধন, ভারতীয় স্থলবাহিনীর পূর্ব পরিকল্পিত অভিযানের মুখে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খণ্ড-বিখণ্ড পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয়বরণ, ঢাকার ভিতরে সর্বত্র বিরুদ্ধচারী মানুষ, সুযোগের প্রতীক্ষারত অগণিত মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকার চারপাশে ভারতের ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর ক্রমসঙ্কুচিত বেষ্টনী এবং শেষ ভরসার স্থল আমেরিকা ও চীনের প্রতিশ্রুত হস্তক্ষেপ পুনরায় পিছিয়ে যাওয়া-এই সমস্ত কিছুর একত্র সমাবেশের ফলে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনানায়কদের মনোবল উঁচু রাখার সামান্যতম অবলম্বন কোথাও ছিল না। প্রত্যাসন্ন বিপর্যয়ের মুখে আত্মসমর্পণের জন্য জেনারেল মানেকশ-এর তৃতীয় ও সর্বশেষ আহ্বানে সাড়া দেওয়াই অবরুদ্ধ পাকিস্তানী নেতৃত্বের পক্ষে প্রাণরক্ষার একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে। অবরুদ্ধ পাকিস্তানী নেতৃত্বের এই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঢাকায় তাদের শেষ প্রতিরক্ষার স্পৃহাকে প্রায় নিঃশেষিত করে ফেলে।
১৩ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তৃতীয় সোভিয়েট ভোটের মুখে যথারীতি বাতিল হয়ে যায়। যে কারণেই হোক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে চীনের সম্মতির সম্ভাবনাকে তখনও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ বাতিল করে উঠতে পারেনি। কাজেই সেই ভরসায় চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে। কিন্তু সামগ্রিক ঘটনাবলী দুষ্টে এই নৌ-অভিযানের পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যের কতখানি অবশিষ্ট ছিল তা অজ্ঞাত। চীনকে নিয়ে বিস্তর টানাটানির পরেও সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে তাদের দৃঢ় সম্মতির অভাব, ঢাকা নগরীতে শেষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে পাকিস্তানী বাহিনীর পরিদষ্ট ব্যর্থতা এবং বঙ্গোপসাগরে ও তার আশেপাশে সোভিয়েট রণতরী ও সাবমেরিন বহরের নীরব সম্বর্ধনা দৃষ্টে সপ্তম নৌবহরের সামরিক লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ অসঙ্গত ছিল না। আর কোনভাবে না হোক, শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনীর উদ্ধারকার্যে নিযুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা দেখা দিতে পারে, ক্রমশ এই ধরনের এক অস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই মার্কিন নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
উপমহাদেশে ১৪ই ডিসেম্বর ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল দিন। একমাত্র ঢাকা শহর এবং গুটিকয় ছোট এলাকা বাদে সারা বাংলাদেশ তখন শত্রুমুক্ত। কোন সরকারী নির্দেশ বা আবেদনের আগেই হাজার হাজার শরণার্থী সহজাত প্রবৃত্তির টানে বিগত কদিন ধরে ফিরতে শুরু করেছে যে যার পরিত্যক্ত বসত, ভিটে-মাটির দিকে। অবশ্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই তখনও স্বদেশমুখী নন। এদের মধ্যে যারা রাজনীতি সচেতন তারা, এমনকি অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রভাতী সংবাদপত্র থেকে আজকেই প্রথম জানতে পারেন, মার্কিন সপ্তম নৌবহর এক অজানা বিপদের হুমকি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটে আসছে। সপ্তম নৌবহর আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য ধ্বংসক্ষমতা সম্পর্কে তাদের অধিকাংশই ছিলেন অনবহিত অথবা নিরুদ্বিগ্ন। সকলেই মত্ত আসন্ন বিজয়ের উল্লাসে, ব্যস্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতিতে। কিন্তু ঢাকায় তখন আসন্ন যুদ্ধ ও সম্ভাব্য ধ্বংসের থমথমে আশঙ্কা। শহরের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা এই সময় পনের থেকে কুড়ি হাজারে উন্নীত বলে অনুমিত। ঢাকাকে মুক্ত করার জন্য সমবেত ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর সংখ্যাও দ্রুত উধ্বমুখী। একটি ভারতীয় ব্রিগেড এবং একটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ঘোড়াশাল থেকে টঙ্গী আসার পথে পুবাইলে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অন্য আর একটি ভারতীয় ব্রিগেডের অর্ধাংশ দাউদকান্দি থেকে হেলিকপ্টারযোগে নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণে এসে পৌঁছায়। ঢাকায় পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের মোকাবিলায় চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনার জন্য ভারতীয় ট্যাঙ্কবহর মেঘনার পশ্চিম পাড়ে আনার চেষ্টা ইতিপূর্বে তিন দিন যাবত ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৪ই ডিসেম্বর ভারতের পিটি-৭৬ উভচর ট্যাঙ্কবহর যখন সাফল্যের সঙ্গে মেঘনা সন্তরণে ব্যস্ত, তখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছ’টি মিগ-২১ ঢাকায় গভর্নর ভবনের উপর আক্রমণ চালিয়ে অধিকৃত এলাকায় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক প্রশাসনকে তৎক্ষণাৎ পদত্যাগে বাধ্য করে, আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীকে মনস্থির করতে সাহায্য করে এবং এমনিভাবে স্থলযুদ্ধের অবধারিত বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও ঢাকা শহরের ধ্বংস ব্যতিরেকেই মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি সম্ভব করে তোলে।