পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানোর ক্ষেত্রে শেষ চেষ্টা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘হট লাইনে’ এই সতর্কবাণী পাঠাবার পর পরই মার্কিন যুদ্ধ-সংকল্পে এক অবিস্মরণীয় উত্থান-পতনের পালা শুরু হয়। নিউইয়র্ক থেকে হুয়াং হুয়া তখনই জানান, পিকিং থেকে এক জরুরী বার্তা এসে পৌঁছেছে এবং তা অবগত হওয়ার জন্য কিসিঞ্জারকে অবিলম্বে নিউইয়র্কে যাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে তাদের মানসিক প্রস্তুতি তখন এমনই তুঙ্গে যে এই বার্তার বিষয়বস্তু কি তা শোনার আগেই নিক্সন ও কিসিঞ্জার সাব্যস্ত করে ফেলেন যে, নিঃসন্দেহে চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করতে চলেছে; এবং চীনের এই সম্ভাব্য অভিযান প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়ন শক্তি প্রয়োগ করবে। এই অনুমানের ভিত্তিতে নিক্সন-কিসিঞ্জার তৎদণ্ডে এ-ও স্থির করে ফেলেন যে সোভিয়েট ইউনিয়নের ব্যাপারে তারা ‘নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন না। সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করে বিশ্বযুদ্ধের এত বড় ঝুঁকি গ্রহণের এহেন ক্ষমতা সম্ভবত সর্বশক্তিমান মার্কিন প্রেসিডেন্টেরই একান্ত অধিকার। কাজেই মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দিয়েই নিক্সন সে দিন ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে চীনকে এই প্রতিশ্রুতি জানিয়ে দেন যে সোভিয়েট ইউনিয়ন যদি চীন আক্রমণ করে তবে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সমুচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুত ব্যবস্থা যে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া আর কিছু ছিল না, তা ঘটনার প্রায় চৌদ্দ বছর পর নিক্সন ‘টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধির কাছে স্বীকার করেন।
কিন্তু হুয়াং হুয়া নিউইয়র্কে ১২ই ডিসেম্বরের বিকেলে আলেকজান্ডার হেগকে অবহিত করেন, চীন কেবল আরেক দফা নিরাপত্তা পরিষদ অধিবেশনে যুদ্ধবিরতির বিষয় আলোচনার ব্যাপারেই আগ্রহী-উপমহাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করার বিষয়ে নয়। সামরিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে চীনের এই ‘অপ্রত্যাশিত ভূমিকার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় এমন ওলট-পালট ঘটে যে বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার পথের দূরত্বে সপ্তম নৌবহর নিশ্চল করে ফেলা হয়। চীনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমেরিকার হস্তক্ষেপ পরিকল্পনা এবং আমেরিকার পরিকল্পনার সঙ্গে ঢাকার প্রতিরক্ষার সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতির প্রশ্ন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকায় চীনের মত পরিবর্তন ছিল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ জন্য দরকার ছিল কিছু সময়ের। সময়ের দরকার ছিল ভারতেরও; কিন্তু তা ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীকে ঢাকার দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই। কাজেই পাকিস্তান ও ভারত উভয় প্রতিনিধির দীর্ঘ বক্তৃতার পর ১২ই ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। ইতিপূর্বে ঐ দিন মধ্যাহ্নে নিক্সন ব্রেজনেভকে যে চরম সতর্কবাণী পাঠান তার জবাবে ১৩ই ডিসেম্বরের ভোর পাঁচটায় হোয়াইট হাউসের ‘হট লাইনে’ মস্কোর নিরুত্তপ্ত জবাব এসে পৌঁছায়: ভারতে সমস্ত ব্যাপার ভাল করে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে ।
এদিকে উপমহাদেশে ১৩ই ডিসেম্বরে নিয়াজীকে জানানো হয়, ঐ দিন পাক বাহিনীর সহায়তার জন্য ‘মিত্রদের’ যে এসে পৌঁছানোর কথা ছিল, তা আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজী করানোর কাজে ইসলামাবাদে সারাদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। পিকিং-এ পাকিস্তানী দূতাবাসকেও দেখা যায় কর্মতৎপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সিকিম-ভুটান সীমান্তে মোতায়েন চীনা সৈন্যবাহিনীকে কিছুটা তৎপর হতে দেখা যায়, কিন্তু ভারতে যে তা বিশেষ উদ্বেগের সঞ্চার করেছিল এমন নয়। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সদরদপ্তরে বাংলাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক অসফল প্রয়াস ঠিক একই সময়ে পরিলক্ষিত হয়।
১২-১৩ই ডিসেম্বরে নিউইয়র্কের মধ্যরাত্রির আগে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে চীনের সম্মতি আদায় সাপেক্ষে সপ্তম নৌবহরকে নিশ্চল করা এবং নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক মুলতবি করার ব্যবস্থা চলছিল, ঠিক সেই সময় কোলকাতায় ১৩ই ডিসেম্বর সকালে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে প্রায় মাসাধিককাল যাবত অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষী যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির প্রধান বক্তব্য ছিল: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবেন। বাংলাদেশ তখন ভারতের সঙ্গে যুগ্ম-কমান্ডব্যবস্থায় আবদ্ধ, কাজেই বাংলাদেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যদি একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতেন, তবে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে এককভাবে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া নীতিগতভাবে অসিদ্ধ হত।
সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই সৈয়দ নজরুল উক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর দানে অসম্মত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের গোচরে আনেন।