পাকিস্তানী মহলের এই শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি সত্ত্বেও রণাঙ্গনে তাদের পশ্চাদপসরণের ধারা তখনও অপরিবর্তিত। ১২ই ডিসেম্বর সকাল আটটায় নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী দখলের অবসান ঘটে। বিকেলে ভারতের আর একটি ইউনিট (৪ গার্ডস) ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। ১০ই থেকে ১২ই ডিসেম্বরের তিন দিনে ভারতীয় বাহিনীর সর্বমোট পাঁচটি ব্যাটালিয়ান, দুটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ৫৭ ডিভিশনের ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার মেঘনা অতিক্রমে সমর্থ হয়। ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের মেঘনা অতিক্রমের প্রচেষ্টা ছিল তখনও অসফল। ১২ই ডিসেম্বর সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে ঢাকা অভিযানের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ পথের সদ্ব্যবহার শুরু হয়। দক্ষিণে ভারতীয় নৌবাহিনী সপ্তম নৌবহরের আসন্ন তৎপরতা সর্ব উপায়ে বিঘ্নিত করার জন্য চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট বড় অবশিষ্ট সকল জাহাজ ও নৌযান, উপকূলীয় অবকাঠামো, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রভৃতি ধ্বংস বা অকেজো করে ফেলে। বঙ্গোপসাগরের জাহাজগামী নৌপথগুলি (sea lane) সঙ্কীর্ণ ও প্রায়শ অগম্ভীর হওয়ায়, অনুমান করা হয়, সপ্তম নৌবহরের বৃহদায়তন জাহাজগুলির পক্ষে উপকূলের নিকটে নোঙ্গর করা অসাধ্য ব্যাপার। তাদের বিমান আক্রমণ ও হেলি উত্তোলন ক্ষমতা যথেষ্ট হলেও, পর্যাপ্ত সংখ্যক উপকূলীয় জলযানের অভাবে স্থলভাগের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা অথবা পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণের কাজ বহুলাংশে দুরূহ হবে বলে মনে করা হয়।
দিল্লীতে কুজনেটসভ এবং মস্কোতে ডি. পি. ধরের যুগপৎ আলোচনার ফলে দ্রুতগতিতে উভয় সরকার মার্কিন ও চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি মোকাবিলায় যুগ্ম ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হন। সপ্তম নৌবহরের আগমন-সংক্রান্ত খবর তখনও (এবং ১৩ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যা পর্যন্ত) ভারতে কেবল স্বল্প সংখ্যক নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সীমিত। তবু মার্কিন প্রশাসনের হুমকির প্রকাশ্য জবাব দান এবং ভারতের জনসাধারণকে আসন্ন বিপদ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীতে বিশেষভাবে আয়োজিত এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ‘সম্মুখের অন্ধকার দিন’ ও ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেন। সেই সঙ্গে সাধারণ পরিষদের সামপ্রতিক আহ্বানের জবাবে এবং পরোক্ষভাবে মার্কিন চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ মহাসচিক উ থানকে এক বার্তায় ইন্দিরা জানান, ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে, একমাত্র যদি পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছুতে সম্মত হয়।
সোভিয়েট ইউনিয়ন যদিও সপ্তম নৌবহরের অনুসরণ/মোকাবিলা করার জন্য ভারত মহাসাগরে তার নিজের নৌবহর জোরদার করে, তবু এ সম্পর্কে ভারতকে অবহিত রাখা ভিন্ন তা নিয়ে কোন প্রচার, সতর্কবাণী উচ্চারণ বা অন্য কোন প্রকার প্ররোচনামূলক কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন সতর্কবাণী এবং ১২ই ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের পূর্বে ভারতকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় বাধ্য করার জন্য চরমপত্র লাভ করা সত্ত্বেও সোভিয়েট সরকার সেগুলি সরাসরি অগ্রাহ্য বা প্রতিবাদ না করে বরং সংলাপের ধারা অব্যাহত রাখেন এবং দাঁতাত প্রক্রিয়ার কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখেই আমেরিকান অভিযোগের সমাধান অন্বেষণে দৃশ্যত সচেষ্ট থাকেন। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা কার্যক্ষেত্রে কালক্ষেপণের সমতুল্য হয়ে ওঠে-যেন এইভাবে বাংলাদেশ যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির জন্য ভারতকে সময় দেওয়াই তাঁদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু যে দু’টি ক্ষেত্রে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল, সেখানে নিঃশব্দে, যথোচিত মাত্রাতে এবং মার্কিন উপগ্রহের ক্যামেরার সামনে তা প্রদর্শিত হয়: মার্কিন নৌশক্তি মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে এবং চীনকে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে সিংকিয়াং সীমান্তে। সোভিয়েট সামরিক শক্তির নিঃশব্দ প্রদর্শনী দ্বিধান্বিত চীনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে সম্পূর্ণ অর্থে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সংলাপ ও শক্তি প্রদর্শনের এই সমন্বয় সম্ভবত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সোভিয়েট কূটনীতির সফলতম দৃষ্টান্তসমূহের অন্যতম।
১২ই ডিসেম্বর রবিবার হওয়া সত্ত্বেও মধ্যাহ্নের বেশ আগে থেকেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় ভারতকে বাধ্য করার প্রশ্নে সোভিয়েট ইউনিয়নের চূড়ান্ত জবাব শোনার জন্য ‘হোয়াইট হাউসের খাস কামরা ‘ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরী কিসিঞ্জার এবং তথ্য সহকারী আলেকজান্ডার হেগ উৎকণ্ঠিতচিত্তে অপেক্ষমাণ ছিলেন। নির্ধারিত সময়সীমার প্রায় দু’ঘণ্টার আগে সোভিয়েট ইউনিয়ন আমেরিকার চরমপত্রের উত্তরে কেবল জানায়, পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতের কোন আক্রমণাত্মক অভিপ্রায় নেই। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন যে উদ্দেশ্যে এই চরমপত্র দেন, সেই মূল বিষয় তথা পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় ভারতকে বাধ্য করার প্রশ্নে সোভিয়েট ইউনিয়ন নীরব থাকে। কাজেই প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরাজয় রোধ করার আর যে কোন উপায় অবশিষ্ট নেই, তা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য নিক্সন এবার অভিযোগ করেন যে, সোভিয়েট জবাবে পাকিস্তানী কাশ্মীরের নিরাপত্তা সম্পর্কে কোন নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নেই (বস্তুত পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্ট্রই একে অপরের অধীনস্থ কাশ্মীরকে বিরোধপূর্ণ মনে করে এবং ৩রা ডিসেম্বরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান ভারতীয় জম্মু ও কাশ্মীরের কিছু অংশ দখল করে নেওয়ায় তা পুনরুদ্ধারের পূর্বে ভারত সরকারের পক্ষে এ জাতীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়, তা ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল. কে. ঝা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে অবহিত করেন)। নিক্সন সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার ব্যাপারে ভারতের অবাধ্যতার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য পুনরায় সেই দিন, অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর বিকালেই নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আয়োজনের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে তিনি আরও কঠোর ভাষায় ‘গুরুতর পরিণতির’ সাবধানবাণী ‘হট লাইন’ মারফত ক্রেমলিনে পাঠান। কিন্তু এবারের সাবধানবাণীতে-ক্রুশ্চভের ভাষায়-‘পারমাণবিক দাঁত বসানো ছিল।