দিল্লীতে তাজউদ্দিন যখন মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনা শুরু করেন, সেই সময় অর্থাৎ ৪ঠা এপ্রিল সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিটগুলির কমান্ডারগণ একত্রিত হন প্রতিরোধ যুদ্ধের সমস্যাবলী আলোচনা এবং সম্মিলিত কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে। এ বৈঠকে যোগ দেন ইবিআর-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, লে. কর্নেল আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। এই প্রথম বিদ্রোহী কমান্ডাররা তাদের আঞ্চলিক অবস্থান ও প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড চিত্রকে একত্রিত করে সারা দেশের সামরিক পরিস্হিতি উপলব্ধি করার সুযোগ পান। কিন্তু যা জানতে পারেন তা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। সব দিকেই পাকিস্তানী বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হতে শুরু করেছে, সবখানেই। বিদ্রোহীরা প্রতিরোধের যথাসাধ্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা-বারুদের অভাব মেটাবার জন্য তারা অবিলম্বে ভারতের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিদেশ থেকে সমর-সম্ভার সংগ্রহ করার জন্য রাজনীতিকদের সমবায়ে যথাশীঘ্র স্বাধীন সরকার গঠনের আবশ্যকতাও তারা অনুভব করেন। কিন্তু সরকার গঠনের জন্য অপেক্ষা না করে, বাস্তব পরিস্থিতির চাপে তারা সমস্ত বিদ্রোহী ইউনিটের সমবায়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং কর্নেল ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সীগুলির মাধ্যমে পূর্ব রণাঙ্গনের প্রতিরোধ সংগ্রামের এই সব ঘটনা ও সিদ্ধান্তের সংবাদ তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছুতে শুরু করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
এই সব বহুমুখী বিকাশ ও সাংগঠনিক প্রস্তুতির কিয়দংশ প্রতিফলিত হয় তাজউদ্দিনের প্রথম বেতার বক্তৃতায়। এপ্রিলের প্রথম
সপ্তাহে দিল্লী অবস্থানকালে তাজউদ্দিনকে স্বাধীনতাযুদ্ধের মূলনীতি সম্বলিত এই বক্তৃতা তৈরীর কাজে সাহায্য করেন রেহমান সোবহান এবং আমিরুল ইসলাম। ১১ই এপ্রিল বাংলাদেশের নিজস্ব বেতার কেন্দ্রের অভাবে শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতার কেন্দ্র থেকে তা প্রচার করা হয়। পরে তা ‘আকাশবাণী’-র নিয়মিত কেন্দ্রসমূহ থেকে পুনঃপ্রচারিত হয়।
এর আগে দিল্লী থেকে কোলকাতা ফিরে তাজউদ্দিন ৮ই এপ্রিল ভবানীপুর এলাকার রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়ীতে কামরুজ্জামানসহ উপস্থিত আওয়ামী ও যুব নেতৃবৃন্দকে দিল্লী বৈঠকের ফলাফল অবহিত করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে কোন্ বিবেচনা থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনকে অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবে উপস্থিত করেন তাও ব্যাখ্যা করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যের ব্যাপারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার যৌক্তিকতা অথবা দিল্লী আলোচনার উপযোগিতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলেননি। তারা অধিকাংশই বিতর্ক তোলেন মুখ্যত তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের বৈধতা নিয়ে। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি অবশ্য মন্ত্রিসভা গঠনেরই বিরোধিতা করেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন সরকার ও সামরিক কমান্ড গঠন-সংক্রান্ত তাজউদ্দিনের প্রস্তাবিত বেতার বক্তৃতা বন্ধ করার দাবী জানান। পরে তিনি ৪২ জন উপস্থিত আওয়ামী লীগ ও যুব নেতার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তাজউদ্দিনের বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক আবেদন পাঠান। তাজউদ্দিন কর্তৃক মন্ত্রিসভা গঠন এবং তার প্রস্তাবিত বেতার ভাষণ রদ করার ক্ষেত্রে বরিশালের সাবেক পরিষদ সদস্য চিত্ত সুতারকে এক উদ্যোগী ভূমিকায় অত্যন্ত তৎপর দেখা যায়। বস্তুত শেখ মণি গ্রুপের সমর্থনে তার তাৎপর্যময় ভূমিকা ১৯৭২ সালের প্রথম অবধি অব্যাহত থাকে।
শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কে বা কারা দেবেন এ বিষয়ে কোন প্রকার সিদ্ধান্ত না থাকায় দলের মধ্যে নেতৃত্ব-কলহ ও বিশৃঙ্খলা একরূপ অবধারিত ছিল। তাজউদ্দিনের আশঙ্কা জন্মায়-মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, ২৬শে মার্চ থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, বাঙালী সশস্ত্রবাহিনীর স্বতঃস্ফুর্ত বিদ্রোহ এবং সম্মিলিত সিপাহী-জনতার প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে অবয়ব ফুটে উঠতে শুরু করেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব-কলহ ও বিশৃঙ্খলা তাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে; বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত আশ্বাস কার্যকর রূপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত অস্থায়ী সরকারের গঠনে কোন বড় পরিবর্তন শেখ মুজিব কর্তৃক সরকার গঠিত হওয়ার দাবী সম্পর্কেই সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতে পারে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত ক্ষতিসাধন করতে পারে।২৬ কাজেই রাজেন্দ্র রোডে সমবেত দলের রাজনৈতিক ও যুবনেতা এবং সাধারণ কর্মীদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাধীন সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাজউদ্দিন অটল থাকেন।
৯ই এপ্রিল সকালে তাজউদ্দিন আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে এক পুরানো ডাকোটা প্লেনে করে প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট সদস্যদের খুঁজতে বের হন। মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা (ধুবড়ীর কাছে) ও শিলচর হয়ে, পথে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে করে, তাজউদ্দিন আগরতলা পৌঁছান ১১ই এপ্রিল। খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং কর্নেল ওসমানী আগরতলায় অপেক্ষা করেছিলেন। এদের মধ্যে দু’দিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক চলার পর অবশেষে তাজউদ্দিন কর্তৃক প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার গঠন ও আয়তন বহাল থাকে। অবশ্য এই মতৈক্যে পৌঁছুবার স্বার্থে মন্ত্রিসভার ক্ষমতার পরিসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করা হয় এবং তা ১৭ই এপ্রিলে ঘোষিত ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়। স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার প্রধান মূল প্রয়োজন দেখা দেয় নবগঠিত সরকারের আইনগত ভিত্তি বৈধকরণের জন্যই। তাজউদ্দিনের ১১ই এপ্রিলের প্রথম বেতার বক্তৃতাকে বৈধ সরকার গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা’র তারিখ ১০ই এপ্রিল বলে ঘোষণা করা হয়।