ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুকূল সাড়া দেবার প্রধান কারণ সম্ভবত ছিল তিনটি। প্রথম কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের নিরবচ্ছিন্ন বৈরী সম্পর্ক এবং তৎকারণে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব। দ্বিতীয় কারণ আদর্শের ক্ষেত্রে, বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্র ও অসামপ্রদায়িকতার প্রশ্নে, আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় কংগ্রেস দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল। তৃতীয় কারণ ছিল মানবিক–পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতায় সারা দুনিয়ার মানুষের মন আলোড়িত হয়েছিল, ভৌগোলিক নৈকট্য হেতু স্বভাবতই ভারতে মানবিক সহানুভূতি ও সমবেদনায় সাড়া পড়েছিল সব চাইতে বেশী। কাজেই ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করার রাজনৈতিক ও মানবিক কারণ ছিল সমভাবে বিদ্যমান।
যে কোন মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনার জন্য প্রধান আবশ্যকীয় শর্ত তিনটি। এক, জনগণের ব্যাপক সমর্থন। দুই, মুক্তিসেনাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এবং তিন, সমরাস্ত্রসহ বিভিন্ন উপকরণের নিয়মিত সরবরাহ। এই তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথমটি, তথা ব্যাপক জনসমর্থন, বিপুলভাবেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও পূর্ব বাংলার স্বল্প আয়তন এবং দখলদার সেনাদের ক্ষিপ্র চলাচল ও আক্রমণ ক্ষমতার দরুন পূর্ব বাংলার কোন অংশই মুক্তিসেনাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। কাজেই মুক্তিবাহিনীর সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য সীমান্তের ওপারে নিরাপদ ঘাঁটির প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে। প্রবাসী সরকারের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় ও অবাধ কাজকর্মের অধিকার লাভের প্রশ্ন ছিল সম পরিমাণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও ছিল সাধারণ শরণার্থীদের আশ্রয় দানের মানবিক প্রশ্ন। নক্সাল আন্দোলনবিক্ষত জনবহুল পশ্চিম বঙ্গের সীমান্ত অগণিত বিদেশী শরণার্থীর জন্য, বিশেষত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য, উন্মুক্ত করা অসামান্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আশ্রয়দানের ব্যাপারে প্রথম থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতি ছিল দ্ব্যর্থহীন। এই সাহসিকতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের পিছনে পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষের অবদান সামান্য নয়। ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদে ৩১শে মার্চ কোলকাতায় যে অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাবনা কোনটিই নয়াদিল্লীর জন্য উপেক্ষণীয় ছিল না।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধী ও তাজউদ্দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দুই দফা বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য অবাধ রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাবার অধিকার প্রদান করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস সাধারণভাবে জ্ঞাপিত হয়। এই সব সাহায্য সহযোগিতার প্রকার ও পরিমাণ সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ধারণা গঠন করা সে মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। তৎসত্ত্বেও তাজউদ্দিন এই উপলব্ধিতে পৌঁছান যে: (১) পাকিস্তান শীঘ্র যদি হত্যা, উৎপীড়ন ও গণবিতাড়নের নীতি থেকে বিরত না হয়, তবে গোটা উপমহাদেশে এক অদৃষ্টপূর্ব উত্তেজনা ও সংঘাতের আবহাওয়া বিস্তার লাভ করবেই; এবং (২) সেই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে ভারতের প্রাথমিক সাহায্যের আশ্বাস উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হয়ে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় পরিণত হতে পারে।
বস্তুত, এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি সিদ্ধান্ত ভারত সরকার গ্রহণ করেন, তার প্রথমটি ছিল ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করার এবং দ্বিতীয়টি ছিল বাংলাদেশ সরকারকে ভারতীয় এলাকায় রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালাবার অধিকার দান করার। এই দুয়েরই তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী। এই কারণে উভয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কেই ভারতীয় মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে এবং উচ্চতর প্রশাসনিক মহলে-বিশেষত পাশ্চাত্যপন্থী অংশের পক্ষ থেকে জোরাল আপত্তি ওঠে। আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক শালীনতার বিষয় ছাড়াও উপরোক্ত দুই সিদ্ধান্ত ভারতের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা সে সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্ন প্রকাশ্য বিরোধিতার রূপ নেবার আগেই ইন্দিরা গান্ধী মূলত একক সিদ্ধান্ত আরোপ করেই সকল মতবিরোধের অবসান ঘটান। মার্চ মাসের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে জয়যুক্ত না হলে তাঁর পক্ষে এই দুই সিদ্ধান্ত এমনিভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হত কি না বলা কঠিন।
আশ্রয় ও মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার বিষয়ে ভারতীয় সম্মতি আদায়ের পর তাজউদ্দিন মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার সুদৃঢ় ভিত্তি খুঁজে পান এবং সংশ্লিষ্ট সমুদয় বিষয়ে সাংগঠনিক পরিকল্পনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন পরিকল্পনার এই পর্যায়ে তাজউদ্দিনের প্রধান বিবেচ্য
বিষয়গুলি ছিল: (ক) মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সীমান্তবর্তী রণাঙ্গন নির্ধারণ, বিভিন্ন রণাঙ্গনের দায়িত্ব অর্পণ এবং অন্তর্বর্তীকালের জন্য সরবরাহ ও সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; (খ) মন্ত্রিসভা গঠন; (গ) স্বাধীনতার স্বপক্ষে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য সাধনের পন্থা নিরূপণ; (ঘ) দেশের অভ্যন্তরে অসহযোগ আন্দোলন সক্রিয় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ; (ঙ) বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র থেকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের আয়োজন; এবং (চ) শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম গঠন।