সীমান্তে পৌঁছুবার পর তাঁর আশাভঙ্গ ঘটে। তিনি দেখতে পান, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারতের সামরিক ইউনিটসমূহের হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নেই; এমনকি অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহের কোন এখতিয়ারও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে নেই। স্থানীয় ভিত্তিতে দু’একটি জায়গায় ব্যতিক্রম থাকলেও সে সব ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অতি সামান্য। মুক্তিফৌজ গঠনের জন্য অস্ত্রশস্ত্র বরাদ্দ করার আবেদনের জবাবে সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ)-প্রধান রুস্তমজী প্রাঞ্জল ভাষায় তাজউদ্দিনকে জানান: মুক্তিফৌজ ট্রেনিং বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এই ট্রেনিং সমাপ্ত হবার পরেই কেবল তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে; কিন্তু এই ট্রেনিং বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের দেওয়া হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্তের সংবাদ এখনও তার জানা নেই; এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবং তাজউদ্দিন চাইলে তাকে দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন মাত্র। তাজউদ্দিন বুঝলেন, ভারতের সঙ্গে কোন ব্যবস্থাই নেই, কাজেই শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।
৩রা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা শুরু করার পূর্বে কয়েকটি মূল বিষয়ে তাজউদ্দিনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখনও তিনি দলের নেতৃস্থানীয় অপরাপর সহকর্মীদের সাক্ষাৎ পাননি। তারা জীবিত কি মৃত, পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী কি সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টায় রত–এমন কোন তথ্যই তখন অবধি তার কাছে পৌঁছায়নি। এই অবস্থায় তাঁকে স্থির করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে তার নিজের ভূমিকা কি হবে? তিনি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসাবে আলাপ করবেন? তাতে বিস্তর সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী পর্যাপ্ত অস্ত্র লাভের কোন আশা আছে কি? বস্তুত তাজউদ্দিনের মনে কোন সন্দেহই। ছিল না যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত তথা কোন বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। কাজেই, সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যদি সরকার গঠন করে থাকেন তবে সেই সরকারের নেতৃস্হানীয় সদস্য হিসাবে তাজউদ্দিনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আসা এবং সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত ও সহজসাধ্য হবে বলে তাজউদ্দিন মনে করেন। অন্ততপক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবেই গণ্য হবে বলে তার ধারণা জন্মায়।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের আগের দিন দিল্লীতে তাঁরই এক ঊর্ধ্বতন পরামর্শদাতা পি.এন. হাকসার তাজউদ্দিনের সাথে আলোচনাকালে জানতে চান, আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে কোন সরকার গঠন করেছে কিনা। এই জিজ্ঞাসা ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা থেকে তাজউদ্দিন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে কি হয়নি সে সম্পর্কে কোন প্রকৃত সংবাদ ভারত কর্তৃপক্ষের জানা নেই এবং সরকার গঠনের সংবাদে তাদের বিস্মিত বা বিব্রত হওয়ারও কোন আশঙ্কা নেই। বরং সরকার গঠিত হয়েছে জানতে পারলে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট ৩১শে মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা এক নির্দিষ্ট ও কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দিনের ধারণা জন্মায়।
এই সব বিচার-বিবেচনা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ২৫/২৬শে মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই (পরে ‘হাইকমান্ড’ নামে যারা পরিচিত হন) মন্ত্রিসভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর ছাড়া অন্যান্য সদস্যের ভাল-মন্দ সংবাদ তখনও যেহেতু সম্পূর্ণ অজানা, সেহেতু তাজউদ্দিন দিল্লীতে সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উপস্থিত করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন।
তাজউদ্দিনের এই উপস্থিত সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্যভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী ‘বাংলাদেশ সরকারের আবেদন অনুসারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা’ দানের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাজউদ্দিনের এই একক ও উপস্থিত সিদ্ধান্ত মুক্তিসংগ্রামের জন্য যতই ফলপ্রসূ হয়ে থাকুক, এর ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও অনিবার্য হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় সমগ্র রাজনীতিকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে রাখে।