প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় উদ্যোগের সমাবেশ ও গঠন প্রথম ধারার মত ঠিক আকস্মিক, অপরিকল্পিত বা অরাজনৈতিক ছিল না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী যুব সংগঠনের চারজন নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ ও আবদুর রাজ্জাক সরাসরি কোলকাতায় এসে পড়েন। শেখ মুজিবের বিশেষ আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত এই চার যুব নেতারই আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীদের উপর বিশেষ প্রভাব ছিল। বিশেষ করে অসহযোগ
আন্দোলন চলাকালে এই তরুণ নেতাদের ক্ষমতা অসামান্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ভারতে প্রবেশের পর থেকে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারে এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠীগত ভূমিকা গ্রহণ করেন। এদের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘Research and Analysis Wing’ (RAW)-এর পষ্ঠপোষকতায় ‘মুজিব বাহিনী’ নামে প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমন এক সশস্ত্রবাহিনীর জন্ম হয়, এক সময় যার কার্যকলাপ স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনেকখানি বিভক্ত করে ফেলে।
এই সংস্থার সাথে তাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ আকস্মিক ছিল না। যতদূর জানা যায়, পাকিস্তানী শাসকবর্গ যদি কোন সময় পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসী হয়, তবে সেই আপৎকালে আওয়ামী লীগপন্থী যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং প্রদানের জন্য শেখ মুজিব ভারত সরকারকে এক অনুরোধ করেছিলেন। এই ট্রেনিং যে উপরোক্ত চার যুব নেতার অধীনে পরিচালিত হবে সে কথা সম্ভবত মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের কোন এক পর্যায়ে তিনি ভারত সরকারকে জানান। শেখ মুজিবের এই কথিত অনুরোধের সত্যাসত্য নিরূপণের কোন উপায় না থাকলেও, এই চার যুবনেতা সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রকাশ্যে দাবী করতে থাকেন যে, সশস্ত্রবাহিনী ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার জন্য শেখ মুজিব কেবল মাত্র তাদের চারজনের ওপরেই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, অপর কারো ওপরে নয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ অবধি তাদের এই দাবী ও ভূমিকা অপরিবর্তিত থাকে।
প্রতিরোধ যুদ্ধের তৃতীয় উদ্যোগ যদিও অচিরেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ধারায় পরিণত হয়, তবু সূচনায় তা না ছিল বাঙালী সশস্ত্রবাহিনীর বিদ্রোহের মত অভাবিত, না ছিল যুব ধারার মত ‘অধিকারপ্রাপ্ত’। পাকিস্তানী আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে কার্যত সমগ্র আওয়ামী লীগ সংগঠন দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আক্রমণের অভাবনীয় ভয়াবহতা, সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী নেতার কারাবরণ, পরবর্তী কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে সম্যক অনিশ্চয়তা ইত্যাকার বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও মূলত মধ্যবিত্ত নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ এক দুর্লভ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কাজে প্রয়াসী হয়। আওয়ামী লীগের এই প্রয়াসে অনেক নেতা এবং অগণিত কর্মীর অবদান ছিল। এদের মধ্যে মত ও পথের বিভিন্নতাও ছিল বিস্তর। তৎসত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে এই দল পরিণত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান রাজনৈতিক যন্ত্রে। এবং যন্ত্রের চালক হিসাবে একজনের ভূমিকা ছিল সন্দেহাতীতরূপে অনন্য। তিনি তাজউদ্দিন আহমদ।
তাজউদ্দিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, দুই দশকেরও অধিক কাল ধরে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হবার পর থেকে সকল দলীয় নীতি ও কর্মসূচীর অন্যতম মুখ্য প্রণেতা, দলের সকল মূল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচার বিমুখ সংগঠক। ‘৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবের পরেই ছিল সম্ভবত তার স্থান।
২৫শে মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানী আক্রমণ অত্যাসন্ন, তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দিনকে ঢাকারই শহরতলিতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন যাতে ‘শীঘ্রই তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন।’ তারপর এক নাগাড়ে প্রায় তেত্রিশ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দিনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি-যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাঁকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭শে মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোন নেতৃস্থানীয় সদস্যের সাথে আলাপ-পরামর্শের কোন সুযোগ তাজউদ্দিনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোন বিলম্ব ঘটেনিঃ (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসাবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সব শেষে পাল্টা আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে সসঙ্গী তাজউদ্দিন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০শে মার্চের সন্ধ্যায়। সারা বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহীদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা। স্বাধীনতার জন্য সারা দেশ একতাবদ্ধ।
অধ্যায় ০৩: এপ্রিল
সীমান্ত অতিক্রম করার আগে কয়েকবারই তাজউদ্দিন মনে করেছিলেন হয়তবা এই আপকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে কোন ব্যবস্হা ভারত সরকারের সাথে করা হয়েছে। তাঁর এ কথা মনে করার বিশেষ একটি কারণ ছিল। ৫ই অথবা ৬ই মার্চে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দিন গোপনে সাক্ষাৎ করেন ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে. সি. সেনগুপ্তের সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের শাসকেরা যদি সত্য সত্যই পূর্ব বাংলায় ধ্বংসতাণ্ডব শুরু করে, তবে সে অবস্থায় ভারত সরকার আক্রান্ত কর্মীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান বা সম্ভাব্য প্রতিরোধ সংগ্রামে কোন সাহায্য-সহযোগিতা করবে কিনা জানতে চাওয়া। উত্তরের অন্বেষণে সেনগুপ্ত দিল্লী যান। সারা ভারত তখন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মত্ত। সেখানে সরকারী মনোভাব সংগ্রহ করে উঠতে উঠতে তার বেশ কদিন কেটে যায় এবং ঢাকা ফেরার পর সেনগুপ্ত ১৭ই মার্চে ভাসাভাসাভাবে তাজউদ্দিনকে জানান যে, পাকিস্তানী আঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইসলামাবাদস্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন; তবু আঘাত যদি নিতান্তই আসে’, তবে ভারত আক্রান্ত মানুষের জন্য সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা প্রদান করবে। এই বৈঠকে স্থির হয়, তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের সাথে পরামর্শের পর সেনগুপ্তের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন এবং সম্ভবত তখন তাজউদ্দিন সর্বশেষ পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার প্রকার ও ধরন সম্পর্কে নির্দিষ্ট আলোচনা চালাতে সক্ষম হবেন। ২৪শে মার্চে এই বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব এ বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে না পারায় এবং নির্ধারিত সময়ে তাজউদ্দিনকে অসহযোগ আন্দোলন-সংক্রান্ত নির্দেশাবলী সংশোধনের মুসাবিদায় ব্যস্ত রাখায়, সেনগুপ্তের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সীমান্ত অতিক্রমের আগে তাজউদ্দিন ভেবেছিলেন, হয়তবা ২৪শে মার্চের আলাপ অন্য কারো মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে এবং সম্ভবত এই আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার কোন ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে।