জুন-জুলাইয়ে বাংলাদেশ সামরিক মহলেও মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠার পক্ষে কিছু চিন্তাভাবনা চলছিল। জুলাই মাসে ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্তের পিছনে মুক্তাঞ্চল গঠনের বিবেচনাও যে সক্রিয়, তা কিছুটা প্রকাশ্যেই আলোচনা হয়েছে। ফলে জুলাই মাসেই পাকিস্তানী শাসকদের মনে এমন ধারণা প্রবল হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল যে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সহায়তায় সীমান্তের কাছে এক বা একাধিক মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে পারে। এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্য অনুধাবন করে ইয়াহিয়াচক্র তাদের সেনাবাহিনীর জন্য এক নতুন নির্দেশ জারী করে। এই নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের এক ইঞ্চি ভূমিও যাতে শত্রু কবলিত না হয়, তজ্জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সীমান্ত এলাকার পাহারা জোরদার করতে বলা হয়। এই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে দখলদার বাহিনী সীমান্ত বরাবর ছড়িয়ে পড়ে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে। এর ফল দাঁড়ায় মূলত দুটো।
প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা হ্রাস পায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য লড়াই চালানো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। যদিও রাজাকার বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে পাকিস্তানীরা সৈন্য ঘাটতিজনিত সমস্যার আংশিক সুরাহা করে, তবু তাদের প্রধান বাহিনী সীমান্তের দিকে সরিয়ে না নিয়ে গেলে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের মিলিত শক্তি মোকাবিলা করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুঃসাধ্যের হত।
দ্বিতীয়ত, চৌদ্দশ মাইল দীর্ঘ এ সীমান্ত বাবর ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ার ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর একীভূত শক্তি সেই অনুপাতেই খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ে এবং বড়, এমনকি মাঝারি আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা সবিশেষ হ্রাস পায়। দেশের সীমান্তে মুক্তাঞ্চল গঠিত হবার আশঙ্কাবোধ থেকে পাকিস্তানী বাহিনী যেভাবে দখলকৃত এলাকায় নিজেদের অবস্থানের পুনর্বিন্যাস সাধন করে, তাতে তাদের সম্ভাব্য পরাজয়ের পথ প্রস্তুত হতে শুরু করে।
জুলাই মাসে স্বেচ্ছাসংগ্রামী ছাত্র ও তরুণদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হবার অল্প সময়ের মধ্যে দখলকৃত এলাকায় মে-জুনের তথাকথিত স্থিতিশীলতার অবসান ঘটে, আভ্যন্তরীণ শক্তির ভারসাম্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয় এবং পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত বরাবর সৈন্যবাহিনী বিস্তৃত হওয়ার ফলে একযোগে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গেরিলা বিরোধী যুদ্ধ এবং সীমান্তে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চালাবার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে। অন্যদিকে এই জুলাই মাসেই ভারতের ক্ষমতাসীন দক্ষিণকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তান ও চীন উভয়ের সঙ্গে এমনভাবে নিজকে যুক্ত করে যে, ভারতের নিরাপত্তাহীনতাবোধ তার ফলে চরমে পৌঁছায় এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তিতে পৌঁছানো সম্পূর্ণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ভারত সরকারের উপর মার্কিন প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করায় এবং এর পাশাপাশি, ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্হা সুদৃঢ় করার উদ্যোগ গৃহীত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতের বৃহত্তর সাহায্যের পথ সুপ্রশস্ত হয়।
অধ্যায় ০৮: জুলাই – নভেম্বর
সীমান্ত অতিক্রমের পর থেকে জুন অবধি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনৈক্য ও উপদলীয় কলহ সামান্যই প্রশমিত হয়েছে। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে হতাশা আর ক্ষোভ। ইতিমধ্যে নতুন সরকারকে সংগঠিত করার জন্য প্রশাসনিক, যুব প্রশিক্ষণ ও আঞ্চলিক কমিটি গঠনের যে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার ফল সঞ্চারে তখনও বাকী। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র ও যুবকদের প্রথম দলকে স্বদেশে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সম্প্রসারিত করার স্বার্থে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহত্তর শক্তি সমাবেশের জন্য ভারত সরকার এবং সোভিয়েট প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে আমাদের কথাবার্তা সবে শুরু হয়েছে এবং এসবের ফলাফল তখনও অজ্ঞাত। এই সমুদয় বিষয়ে কিছু অগ্রগতি সাধিত হবার পর, বিশেষত দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পুনরুজ্জীবিত করার পর, দলীয় শৃঙ্খলা বিধানের কাজে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের উদ্বুদ্ধ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হত।
কিন্তু তার পূর্বেই ২০শে জুন কোলকাতায় ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব অশোক রায় যথাশীঘ্র বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেও বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করেন এবং আপত্তি না হলে ২৯শে জুন নাগাদ মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এই অধিবেশনের আয়োজন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। ভারত সরকারের কোন বিশেষ অংশের আগ্রহে বা কোন নির্দিষ্ট বিবেচনা থেকে এই জরুরী অধিবেশন তলবের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে ভারতের ক্ষমতাসীনদের দক্ষিণপন্থী অংশ যে তাজউদ্দিন সম্পর্কে উষ্ণভাব পোষণ করতেন না, তার আভাস ইতিমধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। এ সম্পর্কে কোন জল্পনা-কল্পনা নিরর্থক জেনে এবং যদি কারো সংশয় দেখা দিয়ে থাকে তা নিরসনের জন্য তাজউদ্দিন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেও বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন। সময়ের স্বল্পতা ও যোগাযোগের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে এই অধিবেশন ৫ই ও ৬ই জুলাই শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠানের কথা স্থির হয়। দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার উদ্দেশ্যে গৃহীত ব্যবস্থাদির ফলোভের আগেই নানা কারণে সন্দিহান, বিভক্ত ও বিক্ষুব্ধ প্রতিনিধিদের সম্মুখীন হওয়া তাজউদ্দিন তথা মন্ত্রিসভার জন্য খুব সহজ ছিল না।