পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলঃ (১) পূর্ব বাংলার উপর পাঞ্জাবের তথা পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক আধিপত্য এবং (২) আর্থিক বরাদ্দ লাভের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর নিরঙ্কুশ অধিকার। ছ’দফায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ে এই দুটি স্বার্থই সমূলে বিপন্ন হয়ে পড়ে। কেন্দ্রে একটি দুর্বল বেসামরিক কোয়ালিশন সরকার গঠনের পূর্ববর্তী পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষমতাসীন জান্তা পরোক্ষ পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের আশা ত্যাগ করে এবং তৎপরিবর্তে প্রত্যক্ষ সামরিক পন্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার পরিকল্পনা তৈরিতে উদ্যোগী হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ তেইশ বছর পর প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন ছিল এই প্রথম। নির্বাচনী ফলাফল থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের গঠন ও ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারার প্রশ্নে দেশের দুই অংশের জনমত সম্পূর্ণ বিভক্ত ও পরস্পরবিরোধী; এই পরস্পরবিরোধী জনমতকে একত্রিত বা নিকটবর্তী করার ক্ষমতা কোন রাজনৈতিক দলেরই নেই। পাকিস্তানের এই সুগভীর রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার জন্য ক্ষমতাসীনদের সামনে ছিল মূলত দুটি বিকল্পঃ ছ’দফা কর্মসূচী অনুসারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দুই অঞ্চলের লুপ্ত প্রায় পারস্পরিক আস্থা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা করা; অথবা, নির্বাচনের রায় অগ্রাহ্য করে নগ্ন সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসন প্রবর্তন করা। ১৯৭১ সালে কোন বিকল্প পন্থাই দেশ বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। তবে, প্রথম বিকল্পে যেমন রক্তপাত ও প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল তুলনামূলকভাবে কম, তেমনি উভয় অংশের পূর্ণ বিচ্ছেদ বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল অপেক্ষাকৃত বেশী।
পাকিস্তানী জান্তা তাদের পেশাগত প্রবণতার দরুন সামরিক শক্তি প্রয়োগের পথকে বেছে নেয়। পাকিস্তানের দুরারোগ্য রাজনৈতিক সঙ্কটের ওপর এহেন সামরিক সমাধান চাপিয়ে দেবার সাথে সাথে পাকিস্তানের বিপর্যয় ত্বরান্বিত হয়।
সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন ছিল কিছু সময়ের। কাজেই জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানে নানা গড়িমসির পর ভুট্টোর মাধ্যমে কিছু শাসনতান্ত্রিক বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। জান্তা পরোক্ষভাবে এ কথাই জানিয়ে দেয় যে, ছ’দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র তাদের গ্রহণযোগ্য নয় এবং আওয়ামী লীগ ছ’দফার সংশোধনে সম্মত না হলে পরিষদ অধিবেশনের কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ছ’দফার পক্ষে পূর্ব বাংলার মানুষের সর্বসম্মত রায়ের ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন আপোসরফা ছিল রাজনৈতিক আত্মহত্যার নামান্তর।
তা ছাড়া জাতীয় পরিষদ বৈঠক বাতিলের সাথে সাথে সারা পূর্ব বাংলায় স্বতঃস্ফুর্ত গণ-বিস্ফোরণ ঘটে। এই অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানকে একটি অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত করতে আওয়ামী লীগ অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। গণ-আন্দোলনের উত্তাল জোয়ারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রদেশের সমগ্র প্রশাসন বিভাগ কার্যত এক বিকল্প সরকারে পরিণত হয়। তৎদৃষ্টে সামরিক জান্তা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে একমাত্র চূড়ান্ত আঘাতের মাধ্যমেই বাঙালীদের এই নতুন আত্মপ্রত্যয় প্রতিহত করা সম্ভব।
জানুয়ারী বা সম্ভবত তার আগে থেকেই যে সমর প্রস্তুতির শুরু হয়েছিল, তার অবশিষ্ট আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ধূম্রজাল বিস্তার করা হয়। এই আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যুগপৎ সন্দিহান ও আশাবাদী থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষে আসন্ন সামরিক হামলার বিরুদ্ধে। যথোপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত একই কারণে ২৫/২৬শে মার্চের মধ্যরাতে টিক্কার সমর অভিযান শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী যারা তার সাথে দেখা করেছিলেন, তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েও তাদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ
নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব রয়ে যান নিজ বাসভবনে। সেখান থেকে গ্রেফতার হন হত্যাযজ্ঞের প্রথম প্রহরে। কিন্তু যেভাবেই হোক, ঢাকার বাইরে একথা রাষ্ট্র হয়ে পড়ে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন এবং পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দান করে চলেছেন। সম্ভবত তিন সপ্তাহাধিক কালের অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এমন এক মৌল রূপান্তর ঘটে যে পাকিস্তানীদের নশংস গণহত্যা শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী আক্রমণের সাথে সাথে অধিকাংশ মানুষের কাছে শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ঘোষণা হয়ে ওঠে এক অভ্রান্ত পথ–নির্দেশ।
অধ্যায় ০২: মার্চ-এপ্রিল
২৫/২৬শে মার্চে নিরস্ত্র জনতার উপর পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ সামরিক বর্বরতার ক্ষেত্রে সর্বকালের দৃষ্টান্তকে ম্লান করে ফেললেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আক্রমণ ছিল দুর্বল এবং মূলত আত্মঘাতী। পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের অধিবাসীদের মধ্যে তুলনাহীন ভীতির সঞ্চার করে পাকিস্তানী রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু ঢাকার বুকে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করায় এবং বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় ‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর সদর দফতরের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর ঢালাও আক্রমণ চালাবার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ঢাকার বাইরে ঘটনা মোড় নেয় অভাবনীয় বিদ্রোহের পথে।