অন্যদিকে মে মাসে ‘সমস্ত পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার’ পর জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ অবধি পাকিস্তানী জান্তা তুলনামূলকভাবে নিরুপদ্রবেই ছিল। মার্চ-এপ্রিলের সামরিক নৃশংসতা এবং উপদ্রুত মানুষের অবিরাম দেশত্যাগের ফলে বহির্বিশ্বের বিরূপ প্রচার ও বিরুদ্ধ জনমত মোটামুটি তাদের ধাতস্থ হয়ে এসেছে। কিন্তু জুনের চতুর্থ সপ্তাহে প্যারিস বৈঠকে পাশ্চাত্য সাহায্যদাতা দেশগুলি বাৎসরিক সাহায্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়ায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা তীব্রতর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এই সপ্তাহ থেকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে, তখন তার নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
জুন মাস অবধি দেশের ভিতরে টাঙ্গাইল ও আরো দু-একটি এলাকায় মূলত স্থানীয় সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে কয়েকটি বিদ্রোহী বাহিনী প্রশংসনীয় দক্ষতার সাথে দখলদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছিল। জুন মাসের শেষ দিকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দু’হাজারের কিছু বেশী ছাত্র ও তরুণ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে দেশের অন্যান্য অংশেও সশস্ত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। এদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র ছিল নিতান্ত সামান্য। তবু এদের অসীম মনোবল ও দুঃসাহসিক অভিযানে বড় বড় সেতু ধ্বংস হয়, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হতে থাকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথসহ বিভিন্ন স’ল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, রফতানী হ্রাস পায় এবং পাকিস্তানী সামরিক, আধাসামরিক বাহিনী ও বিশেষত তাদের অসামরিক তাঁবেদারদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসে বিদ্রোহী সশস্ত্রবাহিনী ও রাজনৈতিক কর্মীদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিরোধ থেমে যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পরে স্বেচ্ছাসংগ্রামী এই তরুণদের অকুতোভয় সশস্ত্র লড়াইয়ের ফলে নতুন প্রাণ-সঞ্চার ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের।
এর জবাবে পাকিস্তানী বাহিনী নৃশংসতার মাত্রা তোলে বাড়িয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার সামান্যতম নিদর্শনেও সংশ্লিষ্ট এলাকা ও আশেপাশের বসতির উপর ঢালাও আক্রমণ চালিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে, তরুণদের পাইকারীভাবে আটক ও হত্যা করে সন্ত্রাসের রাজত্বকে আরো বেশী চাঙ্গা করে তোলে। ফলে সৃষ্টি হয় আরও দুঃখ-দুর্দশা, আরও বাস্তুহারা, আরও ক্রোধ এবং ঘৃণা। দখলকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এ কথা প্রমাণ করার জন্য মে মাসের শেষ দিকে। কিছু সংখ্যক বিদেশী সাংবাদিকদের অধিকৃত এলাকায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল। তাদের উপসি’তিতেই সশস্ত্র তরুণদের তৎপরতা শুরু হওয়ায় স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশে ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ শুরু হবার কথা সারা বিশ্বে প্রচারিত হতে থাকে, যেমন প্রকাশিত হতে থাকে। দখলদার সৈন্য বাহিনীর অমানুষিক নিপীড়ন ও নির্যাতনের কাহিনী।
একই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পারাপারকে সহজ করে তোলার জন্য সীমান্ত এলাকাতেও কিছু সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু করা হয়। জুনের শেষ দিকে এবং বিশেষত জুলাই মাসে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি (BOP) নিয়মিতভাবে ধ্বংস করার কাজে নিযুক্ত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলকে বাংলাদেশের যুদ্ধ-অনভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াতের পথকে সুগম (porous) করে তোলে। সমগ্র দখলকৃত এলাকায় পাকিস্তানী গোলন্দাজ রেজিমেন্টের সংখ্যা ছিল পাঁচের অনধিক। দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে ভারতীয় গোলন্দাজ আক্রমণের জবাব দেবার ক্ষমতাও তাদের ছির সীমিত। ভারতের ১০/১২টি ফিল্ডগানের আক্রমণের জবাব পাকিস্তানীরা দিতে পারত মাত্র ২/৩টি ফিল্ডগানের সাহায্যে। ফলে যে সব অঞ্চল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়া-আসার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেই সব অঞ্চলের পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটির পতন ঘটতে থাকে একের পর এক। জুলাইয়ের শেষে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটির শতকরা প্রায় পঞ্চাশভাগ অকেজো হয়ে পড়ে এবং পর্যাপ্ত সৈন্যবলের অভাবে তার অধিকাংশই শেষ অবধি তেমনি অবস্থাতেই পড়ে থাকে।
ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর এই সীমিত তৎপরতার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাকিস্তানী জান্তা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। একই সঙ্গে দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং সীমান্তে ভারতীয় গোলন্দাজ আক্রমণের ফলে তাদের সন্দেহ হয় পূর্ব পাকিস্তানের অংশ বিশেষ দখল করে নেয়াই এই তৎপরতার লক্ষ্য। সম্ভবত তাদের এই সন্দেহ আরও জোরদার হয়ে ওঠে ১২ই জুলাই লন্ডনের ‘টাইমস্ পত্রিকায় বাংলাদেশ শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্ট্যাডিজ এ্যান্ড এ্যানালাইসিস’-এর ডিরেক্টর কে, সুব্রামনিয়ামের অভিমত প্রকাশিত হবার পর। সুব্রামনিয়ামের মতে, শরণার্থী সমস্যার প্রতিবিধানের জন্য ভারতের উচিত পূর্ব বাংলার কোন একটি অংশ মুক্ত করে শরণার্থীদের সেখানে স্থানান্তরিত করা, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকেও সার্বভৌমত্বের মর্যাদাসহ প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এই অভিমতের পক্ষে ভারতের DMO লে. জেনারেল কে. কে. সিং-এর সমর্থনের কথা জানা গেলেও, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিমান প্রতিরক্ষা এবং ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ সামর্থ্য অর্জন করার পূর্বে এরূপ কোন মুক্তাঞ্চলকে পাকিস্তানী প্রতি-আক্রমণ থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ ছিল। একা বাংলাদেশের পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে এ জাতীয় সামর্থ্য অর্জন করার সুযোগ ছিল না। আর ভারত যদি এ ব্যাপারে নিজেরাই দায়িত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হত, তবে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণাও অনিবার্য হয়ে দাঁড়াত। ১৯শে জুলাই ইয়াহিয়ার ঘোষণাতেও স্পষ্ট করে বলা হয়, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানের কোন অংশ দখলের চেষ্টা করে তবে পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করবে।