কিন্তু শরণ সিং দেশে ফিরতে না ফিরতেই ‘নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২১ ও ২২শে জুনে প্রকাশিত হয়, নিরস্ত্র মানুষ হত্যার কাজে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে জেনেও মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের অনুমতিক্রমে পাকিস্তানী দুটি জাহাজ ‘সুন্দরবন’ ও ‘পদ্মা’ সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ’ নিয়ে যথাক্রমে ৮ই মে ও ২১শে জুন পাকিস্তানের উদ্দেশে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে। একই সময়ে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনমনীয়তা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়। বিশ্ব ব্যাংকের ১১ জাতি ‘এইড-টু-পাকিস্তান ক্লাব’ ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় এক বছরের মত উন্নযন সাহায্য স্থগিত রাখার সুপারিশ গ্রহণ করে। কিন্তু ২৮শে জুন তারিখে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, ক্লাবের অন্যান্য দেশ সাহায্য বন্ধ করলেও পাকিস্তানকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে মার্কিন কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। তার পর দিন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রেস অফিসার চার্লস ব্রে ঘোষণা করেন, পরবর্তী দুই এক মাসের মধ্যেই মার্কিন সমরাস্ত্র নিয়ে আরও চার অথবা পাঁচটি জাহাজ পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা দেবে।
জুনের সবচাইতে খারাপ খবর আসে ইসলামাবাদ থেকে। ২৮শে জুন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের বেতার ঘোষণায় বিশেষজ্ঞ দ্বারা নতুন সংবিধান তৈরী করে বেসামরিক প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তাতে প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তরের অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার সামান্যতম ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া চরম আশাবাদীর পক্ষেও দুরূহ হয়ে পড়ে। এক মাস আগে পাকিস্তান সরকারকে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছে বলে নিক্সন যে আশ্বাস দেন তদমর্মে অগ্রগতির কোন নিদর্শন ইয়াহিয়ার বেতার বক্তৃতায় ছিল না।
অবশ্য ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আশাবাদ চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে হেনরী কিসিঞ্জারের নয়াদিল্লী সফরের দু’সপ্তাহের মধ্যে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কিসিঞ্জার বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যদান থেকে বিরত হওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পক্ষান্তরে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ শরণার্থীদের দেশে ফেরার পথ সুগম করার জন্য শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছুবার ব্যাপারে পাকিস্তানীদের উপর চাপ দেওয়ার অনুরোধ করেন এবং তদুদ্দেশ্যে পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বন্ধ করার দাবী জানান। কিসিঞ্জার মুজিবের মুক্তি এবং সামরিক সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে অক্ষমতা ব্যক্ত করলে ইন্দিরা জানান, ভারতের পক্ষেও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য বৃদ্ধি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এমতাবস্হায় পাকিস্তানের পক্ষে ভারত আক্রমণ করার এবং চীনের তাতে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কিসিঞ্জার অভিমত প্রকাশ করেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে কিসিঞ্জার জানান ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধে আমেরিকা নিরপেক্ষ থাকলেও চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সহায়তা করার পূর্ববর্তী ভূমিকা অপরিবর্তিত থাকবে।
কিসিঞ্জার অতঃপর পাকিস্তান যান। কিন্তু সেখান থেকে তিনি চীনের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য গোপনে পিকিং সফরে যান। কিসিঞ্জারের এই অপ্রত্যাশিত সফরে ভারতের সরকারী মহলের সর্বস্তরে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিরোধে মার্কিন ভূমিকা সম্পর্কে বিরাট সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন অদূর ভবিষ্যতে চীন সফরে যাবেন, সে সংবাদ সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু সবচাইতে বড় আঘাতের তখনও বাকী। পিকিং থেকে ওয়াশিংটন ফেরার কয়েকদিন পর চীনের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের পূর্বতন প্রতিশ্রুতির সংশোধন করে কিসিঞ্জার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল. কে. ঝা-কে অবহিত করেন, চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তবে সে ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। ফলে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাতের পর সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের সীমান্ত সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি ভারতকে দিয়েছিল, এমনকি মাত্র দশ দিন আগেও কিসিঞ্জারের মুখে যা অংশত পুনর্ব্যক্ত হয়েছিল, তার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। চীনের সাথে নির্মীয়মাণ সম্পর্কের স্বার্থে তাদের পূর্ববর্তী ভূমিকার এত বড় পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, না তার চীন সফরের ফলে সৃষ্ট পরিসি’তিকে মূলধন করে মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা প্রদান থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করাই কিসিঞ্জারের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, তা ইতিহাস গবেষণার বিষয়বস্তু।
কিসিঞ্জারের নতুন বক্তব্যের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বা মধ্যস্থতায় শরণার্থী সমস্যা সমাধানের পক্ষে ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আশাবাদ টিকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ভারতে সকল মহলেই উপলব্ধি ঘটে-পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশের মুখে ভারত একা, ভারত নিরাপত্তাবিহীন। এই অবস্থায় কিসিঞ্জারের দাবী অনুসারে বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদান বন্ধ করে আসন্ন যুদ্ধ হয়ত এড়ানো সম্ভব কিন্তু শরণার্থীদের যে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব নয়, তা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কেননা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত অধিকাংশ শরণার্থীর জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তাবোধ ফিরে পাওয়া অসম্ভব ছিল। কাজেই মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা এবং তাদের জয়যুক্ত করার ব্যবস্হা গ্রহণ ভিন্ন শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর যে উপায় নেই, একথা জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় নীতিনির্ধারক মহলে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা প্রদান থেকে ভারতকে বিরত করার জন্য পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই আঁতাত পরিস্ফুট হওয়ার পর ভারতও তার নিজের উত্তর ও উত্তরপূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েট সহযোগিতা লাভে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এমনিভাবে আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।