উত্তরে যা জানানো হয়, তার সার কথা ছিল: (ক) সূচনায় অধিকাংশ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনেই এমন অস্পষ্টতা ও বিশৃঙ্খলা থাকে; (খ) যদি বস্তুগত কারণে সৃষ্ট সঙ্কটের নিষ্পত্তি ঘটার সম্ভাবনা না থাকে, তবে ক্রমশ এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিকতর সংকল্পবদ্ধ ও যোগ্য। মানুষের সমাবেশ ঘটা এবং তাদের সাংগঠনিক কলা-কুশলতা উন্নত হওয়া এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া মাত্র; (গ) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পাকিস্তানের মৌলিক কাঠামোগত স্ববিরোধিতা ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী বিকাশেরই অনিবার্য ফল এবং লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর একে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখার নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন বাংলাদেশের কোন নেতারই নেই, তেমনি স্বাধীনতা বা ছ’ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে সামরিক শাসকদের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই; এবং (ঘ) ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার মত পূর্ণ নিরাপত্তাবোধ খুঁজে পায় তবে তার ফলে ১৯৬৯ সাল থেকে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দণিপন্থীদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার যে ধারা শুরু হয়েছে সম্ভবত তা আরও পরিপুষ্ট হবে; পক্ষান্তরে তথাকথিত ‘রাজনৈতিক সমাধানের আশায় অযথা কালপেণ করলে ক্রমবর্ধিত শরণার্থীর চাপ ইন্দিরা সরকারকে দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পর্যুদস্ত করতে পারে।
প্রথম দিনের এই বৈঠকের পর সোভিয়েট প্রতিনিধির আগ্রহেই এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় বৈঠকের আয়োজন হয়। তারপর আরো দুটি বৈঠক হয় এবং প্রতিবারই সাত/আট দিনের ব্যবধানে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ছোট বড় অজস্র প্রশ্ন তোলা হয়েছে, উত্তরও দেয়া হয়েছে। তারপর এই রুশ সংলাপকারী কোলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ায় এই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সব কথাবার্তার কি ফলাফল হয়েছে, তখন তা জানার কোন উপায় ছিল না। তবে দ্বিতীয় বৈঠক থেকে শুরু করে প্রতিবারেই আলোচনান্তে এই ধারণা নিয়ে আমি ফিরে এসেছি, আমাদের কথা সম্ভবত তাদের সংশ্লিষ্ট মহলে কিছু কিছু পৌঁছাতে শুরু করেছে।
অধ্যায় ০৭: জুন – জুলাই
জুন ও বিশেষত জুলাই মাসে বিভিন্নমুখী ঘটনার সমাবেশ ও ঘাত প্রতিঘাতে উপমহাদেশের পরিস্থিতি গভীরতর সংঘাতের দিকে মোড় নেয়। বাংলাদেশ সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে মার্কিন সহায়তা লাভের যে আশাবাদ ভারতের ক্ষমতাসীন দক্ষিণের ছিল, জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তা হ্রাস পেতে শুরু করে। জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতির পরিবর্তন সহসা এমনভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যার ফলে ভারতের নিরাপত্তাহীনতাবোধ চরমে পৌঁছে এবং নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্বেষণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠে। অন্যদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পুনর্দখলের ফলে সৃষ্ট পাকিস্তানী শাসকদের আত্মপ্রসাদ জুন মাসের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে ম্লান হতে শুরু করে। এই এলাকায় তাদের দখল কায়েম রাখার সমস্যা নতুন করে প্রকট হয়ে ওঠে সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র ও তরুণদের সশস্ত্র তৎপরতার সূচনাতে। একই সময়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার ছোটখাট সংঘাতের ফলে এ অঞ্চলে পাকিস্তানীরা তাদের সামরিক অবস্হানকে সীমান্ত বরাবর এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করে, যার ফলে তাদের সামরিক শক্তি ক্রমশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়তে শুরু করে। আর সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বিশৃঙ্খলাভাব অনেকটা দূর হয় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শিলিগুড়িতে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদেও বৈঠকের পর। এর ফলে অস্থায়ী মন্ত্রিসভা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও সংহত হয়। এ ছাড়া ১০ই জুলাই থেকে সপ্তাহকালব্যাপী বৈঠকের ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক বিন্যাস ও কর্মপদ্ধতিতে কিছু শৃঙ্খলার সূচনা ঘটে।
গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে পাশ্চাত্য দেশগুলির অধিকাংশ পত্রপত্রিকা এবং জনপ্রতিনিধিদের উল্লেখযোগ্য অংশ সামরিক চক্রের নীতির বিরুদ্ধে প্রশংসনীয়ভাবে সোচ্চার থাকায় একথা মনে হওয়ার অবকাশ ছিল যে, এই সব দেশের সরকার স্ব স্ব জনমত অনুসারে শীঘ্রই হয়ত সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য পাকিস্তানী জান্তর উপর চাপ প্রয়োগ করবেন। ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আশান্বিত হওয়ার কারণ ছিল আরও কিছু বেশী। ২৮শে মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লিখিত এক চিঠিতে জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া সরকারকে এক রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজী করানোর জন্য নীরবে কাজ করে চলেছে। পক্ষকালের মধ্যেই ভারতের বিদেশ মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং আমেরিকা পাড়ি দেন পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার অনুরোধ নিয়ে। তার সফর শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের সংযমের প্রশংসা করে বলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক পর্যায়ে সমঝোতা স্থাপন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পরেই শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব। তখনও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বৈদেশিক নীতি ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও ‘হোয়াইট হাউসের’ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মতের গড়মিল তথা, পররাষ্ট্র সচিব রোজার্স প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরী কিসিঞ্জারের মধ্যে প্রেক্ষিতবোধের তারতম্য এবং ব্যক্তিগত বিরোধ ও সংশ্লিষ্ট বৈরিতা বাইরে ততটা স্পষ্ট নয়। কাজেই মার্কিন মুখপাত্রের ঘোষণা ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলে আরও কিছু আশার সঞ্চার করে।