পক্ষান্তরে, ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কেন্দ্রের বাম হিসাবে যারা পরিচিত, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ নাকচ না করেও শরণার্থী চাপ থেকে ভারতকে মুক্ত করার অন্যান্য বিকল্প পদক্ষেপ বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন। এবং এই কারণে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থায় বা বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি কোন যুক্তিসঙ্গত পরিবর্তনের প্রয়োজন ঘটেও তবে তা গ্রহণ করতে এই অংশের কোন বড় আপত্তি ছিল না। ফলে ভারতে আগত ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই, সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ চালানো ব্যতীত অন্য উপায় নেই, এই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য ভারতের সর্বাত্মক সাহায্য প্রদান ছাড়া অন্য উপায় নেই, ভারতের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের আগে তার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারতের অন্য কোন উপায় নেই–পরিস্থিতির এই গ্রন্থিবদ্ধ যুক্তিতে তাদের সাড়া পাওয়া যায় প্রথম আলাপেই। যেমন, দিল্লীতে পি. এন. হাকসারের সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু বামপন্থী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডানিয়েল থর্নার আমার যে বৈঠকের আয়োজন করেন, সেখানে পরিস্থিতির এই যুক্তি উত্থাপনের পর আলোচনা চার ঘণ্টারও অধিক সময় স্থায়ী হয় এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অধ্যাপক পি. এন. ধর সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলোচনার শেষ পর্যায়ে তাদেরকে আমি জানাই যে, আমার ভূমিকা বেসরকারী হলেও (ন্যাপের একজন সাধারণ সদস্য হিসাবেই নিজকে পরিচিত করি) পরিস্থিতির এই মূল্যায়ন ও পলিসি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং বর্তমান সংগ্রাম যাতে সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে তজ্জন্য মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত দুটি দল সমেত স্বাধীনতা সমর্থক সব কটি দলের সমবায়ে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারেও তাঁর পূর্ণ সম্মতি রয়েছে।
সম্ভবত আমার এই সর্বশেষ দাবীর সারবত্তা যাচাইয়ের জন্য আমাকে দু’দিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করা হয়। দু’দিন পর পুনরায় যখন হাকসারের সঙ্গে মিলিত হই, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্য গড়ে তোলার বাস্তব নানা দিক ও সম্ভাব্য সময়সূচী নিয়েই বেশীরভাগ সময় আমরা আলাপ করি। বিদায়ের আগে হাকসার জানান, ভারতস্থ সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত বা ঐ পর্যায়ের কোন কূটনীতিকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা এবং নিয়মিত রাজনৈতিক মতবিনিময়ের চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্রশ্নে রাশিয়ার সাথে কোন সমঝোতায় পৌঁছাবার চেষ্টা তারা করবেন কি না, হাকসার সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করলেও, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সমর্থক। রাজনৈতিক দলগুলির মিলিত ফ্রন্ট গঠনে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ শুরু করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করে তিনি আমার মনে এই ধারণারই সৃষ্টি করেন। যে, আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে আনার পক্ষে আমাদের ফর্মুলা তাদের বিবেচনার অযোগ্য নয়। ঠিক সেই মুহূর্তে কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছার অসুবিধা তাদের থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সম্ভাব্য সকল কিছু করার ব্যাপারে ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্রের বাম অংশের আন্তরিকতার অভাব হবে না বলে আমার ধারণা জন্মে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্রের দক্ষিণের আয়তন ও প্রভাব তুলনামূলকভাবে বড় হওয়ায় ভারত সরকারের সামগ্রিক শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিয়োজিত হবে কি না সে সম্পর্কে বিরাট জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি কোলকাতা ফিরে আসি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে একটি কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করি: দক্ষিণ ও বাম, সঙ্কীর্ণ ও উদার-এই নানা উপাদানে গঠিত ভারতের ক্ষমতার যন্ত্র কোন অখণ্ড শিলা নয়; ভারতের ক্ষমতা-যন্ত্রের অভ্যন্তরে দক্ষিণ ও বামের টানাপোড়েন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বা বিপক্ষে চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম।
দক্ষিনপন্থীদের এই প্রাধান্য অনুধাবন করা সত্ত্বেও উদ্ভূত সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে তাদের আশাবাদ যে বেশী দিন স্থায়ী হতে পারে না সে বিষয়ে আমাদের উভয়েরই কোন সন্দেহ ছিল না। কাজেই ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রে দক্ষিণ ও বামের এই টানাপোড়েনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে সোভিয়েট প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তাজউদ্দিন অনুমোদন করেন। উভয় পক্ষের মতের আদান-প্রদান যাতে অবাধে এগুতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন আমাকে একা ও অত্যন্ত গোপনে এই যোগাযোগ শুরু করতে বলেন। এই বেসরকারী আলোচনা যে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহের ফলেই সংঘটিত হতে চলেছে সে বিষয়ে সোভিয়েট পরে আস্থা উৎপাদন এবং বৈঠকের ব্যবস্থা সম্ভব হয় ‘প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রকাশক অরুণা আসফ আলীর সহায়তায়।
কোলকাতায় প্রথম দিনের আলোচনায় সোভিয়েট প্রতিনিধি ভি. আই. গুরগিয়ানভ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে এক নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা, বিঘোষিত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দুর্বলতা, দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে দেশের ভিতরে সংগঠন সৃষ্টির উপায় ও নেতৃত্বের সমতা, ভারতের ক্ষমতাসীন শ্রেণী-স্বার্থের সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তি ও মেয়াদ প্রভৃতি সব ক’টি মূল বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই অপ্রত্যাশিত স্পষ্ট ভাষণের ফলে সোভিয়েট দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনুধাবন করা আমার পক্ষে অনেকখানি সহজ হয়।