মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সোভিয়েট ইউনিয়নসহ বিশ্বের অপরাপর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করার দ্ব্যর্থহীন আহ্বান জানান। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মার্কিনী সামরিক জোট-ঘেঁষা বৈদেশিক নীতির জন্য (এবং ষাট দশকের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ জোট-নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করা সত্ত্বেও) আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে ধারণা বিদ্যমান ছিল তা দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগ অনেকখানি সহায়ক হয়। বস্তুত আমেরিকা-ঘেঁষা দল হিসাবে আওয়ামী লীগের এই পূর্বতন পরিচিতি এবং বিশেষত আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাদের দক্ষিণপন্থী মনোভাবের দরুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে যে বেশ বেগ পেতে হবে, তা ইতিমধ্যেই তাজউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষত মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত দলগুলির সঙ্গে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজন এক নতুন গুরুত্ব অর্জন করে। কাজেই নীতিগতভাবে স্থির করা হয়, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের নিরাপত্তার ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য যদি সোভিয়েট সহযোগিতা ভারত সরকারের কাম্য হয়, তবে সেই প্রক্রিয়াকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অন্তত মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে সম্মত হতে হবে।
কাজেই মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহে আমার দিল্লী যাওয়ার আগে মোটামুটি স্থির হয়, দিল্লীতে আমার করণীয় হবে: (১) মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণমাত্রায় সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভারতীয় সমতা পরিমাপ করার চেষ্টা করা; (২) আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে আনার প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে ভারতের উচ্চতর ক্ষমতাসীন মহলকে আভাস-ইঙ্গিত দেওয়া; এবং (৩) সম্ভব হলে, সংশ্লিষ্ট পলিসি ও কর্মসূচী সমন্বয়ের জন্য পরবর্তী আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। একমাত্র বেসরকারী পর্যায়েই এই ধরনের নাজুক মূল্যায়ন ও আলাপ-আলোচনা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। এ ছাড়া আরো একটি কারণ ছিল। মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও আওয়ামী লীগের উপদলীয় পরিস্থিতি এমনই ছিল যে, এই চিন্তার সামান্যতম প্রকাশেও তাজউদ্দিন আরও একটি গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারতেন। তাজউদ্দিন তাই এইভাবে দলীয় ও মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সবার অগোচরে ভারতের উধ্বর্তনমহলে মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন সম্পর্কে তার নিজস্ব অভিমত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।
দিল্লীতে নদিন অবস্থানকালে ঠিক সরকারী দায়িত্বে নিযুক্ত নন, অথচ ক্ষমতাসীন মহলে অত্যন্ত প্রভাবশালী এমন কিছু ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি নির্ধারণের কাজে প্রত্যক্ষভাবে নিযুক্ত এমন কিছু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে আমার এক বা একাধিক বার আলোচনার সুযোগ হয়। এদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি. এন. হাকসার, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অধ্যাপক পি. এন. ধর, পররাষ্ট্র সচিব টি. এন. কল, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শদাতা হিসাবে পরিগণিত পাকিস্তান প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জি. পার্থসারথি, পরিকল্পনা মন্ত্রী সি. সুব্রামনিয়াম, ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্ট্যাডিজ এ্যান্ড এ্যানালাইসিসের’ পরিচালক কে. সুব্রামনিয়াম, এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর চীফ অব স্টাফের মিলিটারী সেক্রেটারী মেজর জেনারেল বি. এন. সরকার (যিনি দু’মাস পরেই মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্বে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের ডিরেক্টর অপারেশনস্ নিযুক্ত হন)। এ ছাড়াও আলোচনা হয় ভারতের জাতীয় সংবাদ দৈনিকের তিনজন সম্পাদক, কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকজনের সঙ্গে। এই সমুদয় আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের ক্ষমতাসীন মহলের মনোভাবের কয়েকটি ধারার সন্ধান পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি সত্ত্বেও এই সংগ্রামকে সাহায্য করার পরিসর ও উপায় নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীনমহলে বিরাট মতপার্থক্য আমি লক্ষ্য করি এবং কেন্দ্রের দক্ষিন ও বামের মধ্যে কোন অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বেশ দুরূহ বলে আমার মনে হয়। কেন্দ্রের দক্ষিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য সম্পর্কে অনেক বেশী সন্দিহান, মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের নেতৃত্ব বামপন্থীদের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় চিন্তিত, পাকিস্তানের সপক্ষে চীন ও আমেরিকার সাহায্যের মুখে ভারতের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার ফলে আমেরিকান প্রভাব বলয় থেকে আরো দূরে সরে গিয়ে রাশিয়ার উপর ভারতের নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কায় সবিশেষ ব্রিবত অথবা শঙ্কিত। এমনকি, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যে ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয়, তেমন মতেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এই মহলে। এই মত অনুসারে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি কোন বিপদ নেই, বিপদ একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই; কাজেই পশ্চিম পাকিস্তান যদি দীর্ঘদিনের জন্য পূর্বাঞ্চলের গৃহযুদ্ধ দমনের কাজে নিজের সামরিক সম্পদকে নিযুক্ত রাখতে বাধ্য হয় তবে সে অবস্থায় ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তা অপেক্ষাকৃত উন্নত হওয়া সম্ভব। কাজেই ভারতের জাতীয় স্বার্থ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, বরং অল্পস্বল্প গোপন সাহায্যের মাধ্যমে এই বিদ্রোহকে প্রলম্বিত করাই তাদের পক্ষে বুদ্ধিসম্মত। পাশাপাশি বহুজাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও বিশ্বজনমত গঠনের মাধ্যমে আমেরিকান সরকারকে যদি পাকিস্তানের উপর উপযুক্ত চাপ প্রয়োগে সম্মত করানো যায় এবং এর ফলে পাকিস্তান সরকারকে। যদি শেখ মুজিবের সাথে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছুতে বাধ্য করা যায়, তবে ভারত একদিকে যেমন শরণার্থীর অসহ চাপ থেকে মুক্ত হবে, তেমনি অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিক্ষত দুর্বল পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা ভারতের পক্ষে সহজ হবে। এই সমস্ত যুক্তির মর্মার্থ ছিল, শরণার্থী সমস্যা থেকে উদ্ধারের চেষ্টার অতিরিক্ত কোন আকাঙ্ক্ষা তথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভারতের জন্য অহেতুক ঝুঁকি, সমস্যা ও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে। কিন্তু এদের যুক্তির সবচাইতে বড় দুর্বলতা ছিল, পাকিস্তানী শাসকদের মনোভাব পরিবর্তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার উপর এদের সার্বিক নির্ভরশীলতা। যেন মার্কিন সরকার ইচ্ছা করলেই পাকিস্তানের কাঠামোগত স্ববিরোধিতা ও রাজনীতির মৌল বিচ্ছেদের সমাধান ঘটে যাবে।